বিপুল শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী নবী ছিলেন মাত্র
দু’জন। তাঁরা হ’লেন পিতা ও পুত্র দাঊদ ও সুলায়মান (আঃ)। বর্তমান ফিলিস্তীন
সহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) এলাকায় তাঁদের রাজত্ব ছিল। পৃথিবীর অতুলনীয়
ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁরা ছিলেন সর্বদা আল্লাহর প্রতি অনুগত ও সদা
কৃতজ্ঞ। সেকারণ আল্লাহ তার শেষনবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, واصْبِرْ عَلَى مَا يَقُولُونَ وَاذْكُرْ عَبْدَنَا دَاوُودَ ذَا الْأَيْدِ إِنَّهُ أَوَّابٌ-(ص ১৭)- ‘তারা যেসব কথা বলে তাতে তুমি ছবর কর এবং আমার শক্তিশালী বান্দা দাঊদকে স্মরণ কর। সে ছিল আমার প্রতি সদা প্রত্যাবর্তনশীল’ (ছোয়াদ ৩৮/১৭)।
দাঊদ হলেন আল্লাহর একমাত্র বান্দা, যাকে খুশী হয়ে পিতা আদম স্বীয় বয়স
থেকে ৪০ বছর কেটে তাকে দান করার জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করেছিলেন এবং
সেমতে দাঊদের বয়স ৬০ হ’তে ১০০ বছরে বৃদ্ধি পায়[1]
উল্লেখ্য যে, হযরত দাঊদ (আঃ) সম্পর্কে কুরআনের ৯টি সূরায় ২৩টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[2] তিনি ছিলেন শেষনবী (ছাঃ)-এর আগমনের প্রায় দেড় হাযার বছরের পূর্বেকার নবী[3]
দাঊদ কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়েই শক্তিশালী হননি, বরং তিনি
জন্মগতভাবেই ছিলেন দৈহিকভাবে শক্তিশালী এবং একই সাথে ঈমানী শক্তিতে
বলিয়ান। নিম্নোক্ত ঘটনায় তা বর্ণিত হয়েছে।-
সাগরডুবি থেকে নাজাত পেয়ে মূসা ও হারূণ (আঃ) যখন
বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে শামে এলেন এবং শান্তিতে বসবাস করতে থাকলেন, তখন
আল্লাহ তাদেরকে তাদের পিতৃভূমি ফিলিস্তীনে ফিরে যাবার আদেশ দিলেন এবং
ফিলিস্তীন দখলকারী শক্তিশালী আমালেক্বাদের সঙ্গে জিহাদের নির্দেশ দিলেন।
সাথে সাথে এ ওয়াদাও দিলেন যে, জিহাদে নামলেই তোমাদের বিজয় দান করা হবে (মায়েদাহ ৫/২৩)। কিন্তু এই ভীতু ও জিহাদ বিমুখ বিলাসী জাতি তাদের নবী মূসাকে পরিষ্কার বলে দিল, اذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلا إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ-(المائدة ২৫)- ‘তুমি ও তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)। এতবড় বেআদবীর পরে মূসা (আঃ) তাদের ব্যাপারে নিরাশ হ’লেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই দু’ভাই পরপর তিন বছরের ব্যবধানে মৃত্যু বরণ করলেন।
জিহাদের আদেশ অমান্য করার শাস্তি স্বরূপ মিসর ও
শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে চল্লিশ বছর যাবত উন্মুক্ত কারাগারে
অতিবাহিত করার পর মূসার শিষ্য ও ভাগিনা এবং পরবর্তীতে নবী ইউশা‘ বিন নূনের
নেতৃত্বে জিহাদ সংঘটিত হয় এবং আমালেক্বাদের হটিয়ে তারা ফিলিস্তীন দখল
করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তারা পুনরায় বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয় এবং
নানাবিধ অনাচারে লিপ্ত হয়। তখন আল্লাহ তাদের উপরে পুনরায় আমালেক্বাদের
চাপিয়ে দেন। বনু ইস্রাঈলরা আবার নিগৃহীত হ’তে থাকে। এভাবে বহু দিন কেটে
যায়। এক সময় শ্যামুয়েল (شمويل)
নবীর যুগ আসে। লোকেরা বলে আপনি আমাদের জন্য একজন সেনাপতি দানের জন্য
আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, যাতে আমরা আমাদের পূর্বের ঐতিহ্য ফিরে পাই এবং
বর্তমান দুর্দশা থেকে মুক্তি পাই। এই ঘটনা আল্লাহ তার শেষনবীকে শুনিয়েছেন
নিম্নোক্ত ভাষায়-
أَلَمْ تَرَ إِلَى الْمَلإِ مِن بَنِي
إِسْرَائِيلَ مِن بَعْدِ مُوسَى إِذْ قَالُوْا لِنَبِيٍّ لَّهُمُ
ابْعَثْ لَنَا مَلِكاً نُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللهِ قَالَ هَلْ
عَسَيْتُمْ إِنْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ أَلاَّ تُقَاتِلُوْا
قَالُوْا وَمَا لَنَا أَلاَّ نُقَاتِلَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَقَدْ
أُخْرِجْنَا مِنْ دِيَارِنَا وَأَبْنَآئِنَا فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ
الْقِتَالُ تَوَلَّوْا إِلاَّ قَلِيلاً مِّنْهُمْ وَاللهُ عَلِيمٌ
بِالظَّالِمِيْنَ- (البقرة ২৪৬)-
‘তুমি
কি মূসার পরে বনু ইস্রাঈলদের একদল নেতাকে দেখনি, যখন তারা তাদের নবীকে
বলেছিল, আমাদের জন্য একজন শাসক প্রেরণ করুন, যাতে আমরা (তার নেতৃত্বে)
আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি। নবী বললেন, তোমাদের প্রতি কি এমন ধারণা করা
যায় যে, লড়াইয়ের নির্দেশ দিলে তোমরা লড়াই করবে? তারা বলল, আমাদের কি হয়েছে
যে, আমরা আল্লাহর পথে লড়াই করব না? অথচ আমরা বিতাড়িত হয়েছি নিজেদের
ঘর-বাড়ি ও সন্তান-সন্ততি হ’তে! অতঃপর যখন লড়াইয়ের নির্দেশ হ’ল তখন সামান্য
কয়েকজন ছাড়া বাকীরা সবাই ফিরে গেল। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যালেমদের ভাল করেই
জানেন’ (বাক্বারাহ ২/২৪৬)। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:-
وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ
اللهَ قَدْ بَعَثَ لَكُمْ طَالُوتَ مَلِكاً قَالُوْا أَنَّى يَكُونُ
لَهُ الْمُلْكُ عَلَيْنَا وَنَحْنُ أَحَقُّ بِالْمُلْكِ مِنْهُ وَلَمْ
يُؤْتَ سَعَةً مِّنَ الْمَالِ قَالَ إِنَّ اللهَ اصْطَفَاهُ عَلَيْكُمْ
وَزَادَهُ بَسْطَةً فِي الْعِلْمِ وَالْجِسْمِ وَاللهُ يُؤْتِي مُلْكَهُ
مَن يَّشَآءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ- وَقَالَ لَهُمْ نِبِيُّهُمْ
إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ أَن يَّأْتِيَكُمُ التَّابُوْتُ فِيْهِ
سَكِيْنَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَبَقِيَّةٌ مِّمَّا تَرَكَ آلُ مُوْسَى
وَآلُ هَارُونَ تَحْمِلُهُ الْمَلآئِكَةُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً
لَّكُمْ إِنْ كُنْتُم مُّؤْمِنِيْنَ-(البقرة ২৪৭-২৪৮)-
‘তাদের
নবী তাদের বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তালূতকে তোমাদের জন্য শাসক নিযুক্ত
করেছেন। তারা বলল, সেটা কেমন করে হয় যে, তার শাসন চলবে আমাদের উপরে। অথচ
আমরাই শাসন ক্ষমতা পাওয়ার অধিক হকদার। তাছাড়া সে ধন-সম্পদের দিক দিয়েও
সচ্ছল নয়। জওয়াবে নবী বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপরে তাকে মনোনীত
করেছেন এবং স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের দিক দিয়ে তাকে প্রাচুর্য দান করেছেন।
বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন। তিনি হ’লেন প্রাচুর্য দানকারী ও
সর্বজ্ঞ’। ‘নবী তাদেরকে বললেন, তালূতের নেতৃত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের
কাছে (তোমাদের কাংখিত) সিন্দুকটি আসবে তোমাদের প্রভুর পক্ষ হ’তে তোমাদের
হৃদয়ের প্রশান্তি রূপে। আর তাতে থাকবে মূসা, হারূণ ও তাদের পরিবার বর্গের
ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বহন করে আনবে ফেরেশতাগণ।
এতেই তোমাদের (শাসকের) জন্য নিশ্চিত নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী
হও’ (বাক্বারাহ ২/২৪৭-২৪৮)।
বিষয়টি এই যে, বনু ইস্রাঈলগণের নিকটে একটা
সিন্দুক ছিল। যার মধ্যে তাদের নবী মূসা, হারূণ ও তাঁদের পরিবারের ব্যবহৃত
কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী ছিল। তারা এটাকে খুবই বরকতময় মনে করত এবং
যুদ্ধকালে একে সম্মুখে রাখত। একবার আমালেক্বাদের সাথে যুদ্ধের সময় বনু
ইস্রাঈলগণ পরাজিত হ’লে আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূত উক্ত সিন্দুকটি নিয়ে
যায়। এক্ষণে যখন বনু ইস্রাঈলগণ পুনরায় জিহাদের সংকল্প করল, তখন আল্লাহ
তাদেরকে উক্ত সিন্দুক ফিরিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। অতঃপর এই সিন্দুকটির
মাধ্যমে তাদের মধ্যেকার নেতৃত্ব নিয়ে ঝগড়ার নিরসন করেন। সিন্দুকটি তালূতের
বাড়ীতে আগমনের ঘটনা এই যে, জালূতের নির্দেশে কাফেররা যেখানেই সিন্দুকটি
রাখে, সেখানেই দেখা দেয় মহামারী ও অন্যান্য বিপদাপদ। এমনিভাবে তাদের
পাঁচটি শহর ধ্বংস হয়ে যায়। অবশেষে অতিষ্ট হয়ে তারা একে তার প্রকৃত
মালিকদের কাছে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল এবং গরুর গাড়ীতে উঠিয়ে হাঁকিয়ে
দিল। তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশমতে গরুর গাড়ীটিকে তাড়িয়ে এনে তালূতের
ঘরের সম্মুখে রেখে দিল। বনু ইস্রাঈলগণ এই দৃশ্য দেখে সবাই একবাক্যে
তালূতের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করল। অতঃপর তালূত আমালেক্বাদের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্ত্ততি শুরু করলেন।
সকল প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হ’লে তিনি কথিত মতে
৮০,০০০ হাযার সেনাদল নিয়ে রওয়ানা হন। ইবনু কাছীর এই সংখ্যায় সন্দেহ পোষণ
করে বলেন, ক্ষুদ্রায়তন ফিলিস্তীন ভূমিতে এই বিশাল সেনাদলের সংকুলান হওয়াটা
অসম্ভব ব্যাপার।[4]
অল্প বয়ষ্ক তরুণ দাঊদ ছিলেন উক্ত সেনা দলের সদস্য। পথিমধ্যে সেনাপতি
তালূত তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। সম্মুখেই ছিল এক নদী। মৌসুম ছিল প্রচন্ড
গরমের। পিপাসায় ছিল সবাই কাতর। এ বিষয়টি কুরআন বর্ণনা করেছে নিম্নরূপ:
فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوْتُ
بِالْجُنُوْدِ قَالَ إِنَّ اللهَ مُبْتَلِيْكُمْ بِنَهَرٍ فَمَنْ شَرِبَ
مِنْهُ فَلَيْسَ مِنِّي وَمَنْ لَّمْ يَطْعَمْهُ فَإِنَّهُ مِنِّيْ
إِلاَّ مَنِ اغْتَرَفَ غُرْفَةً بِيَدِهِ فَشَرِبُوْا مِنْهُ إِلاَّ
قَلِيلاً مِّنْهُمْ فَلَمَّا جَاوَزَهُ هُوَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا
مَعَهُ قَالُوْا لاَ طَاقَةَ لَنَا الْيَوْمَ بِجَالُوْتَ وَجُنُوْدِهِ
قَالَ الَّذِيْنَ يَظُنُّوْنَ أَنَّهُم مُّلاَقُو اللهِ: كَم مِّنْ
فِئَةٍ قَلِيْلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيْرَةً بِإِذْنِ اللهِ وَاللهُ
مَعَ الصَّابِرِيْنَ-(البقرة ২৪৯)-
‘অতঃপর
তালূত যখন সৈন্যদল নিয়ে বের হ’ল, তখন সে বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে
পরীক্ষা করবেন একটি নদীর মাধ্যমে। যে ব্যক্তি সেই নদী হ’তে পান করবে, সে
ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়। আর যে ব্যক্তি স্বাদ গ্রহণ করবে না, সেই-ই আমার
দলভুক্ত হবে। তবে হাতের এক অাঁজলা মাত্র। অতঃপর সবাই সে পানি থেকে পান
করল, সামান্য কয়েকজন ব্যতীত। পরে তালূত যখন নদী পার হ’ল এবং তার সঙ্গে ছিল
মাত্র কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি (তখন অধিক পানি পানকারী সংখ্যাগরিষ্ট)
লোকেরা বলতে লাগল, আজকের দিনে জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার
শক্তি আমাদের নেই। (পক্ষান্তরে) যাদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সম্মুখে
তাদের একদিন উপস্থিত হ’তেই হবে, তারা বলল, কত ছোট ছোট দল বিজয়ী হয়েছে বড়
বড় দলের বিরুদ্ধে আল্লাহর হুকুমে। নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন’
(বাক্বারাহ ২/২৪৯)।
বস্ত্ততঃ নদী পার হওয়া এই স্বল্প সংখ্যক
ঈমানদারগণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, যা শেষনবীর সাথে কাফেরদের বদর
যুদ্ধকালে যুদ্ধরত ছাহাবীগণের সংখ্যার সাথে মিলে যায়। পানি পানকারী হাযারো
সৈনিক নদী পারে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ পানি পান করা থেকে বিরত থাকা
স্বল্প সংখ্যক ঈমানদার সাথী নিয়েই তালূত চললেন সেকালের সেরা সেনাপতি ও
শৌর্য-বীর্যের প্রতীক আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূতের বিরুদ্ধে।
বস্ত্তবাদীগণের হিসাব মতে এটা ছিল নিতান্তই আত্মহননের শামিল। এই দলেই
ছিলেন দাঊদ। আল্লাহ বলেন,
وَلَمَّا بَرَزُوْا لِجَالُوْتَ
وَجُنُوْدِهِ قَالُوْا رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْراً وَّثَبِّتْ
أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِيْنَ-(البقرة ২৫০)-
‘আর যখন তারা জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সম্মুখীন
হ’ল, তখন তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ধৈর্য দান কর ও আমাদেরকে
দৃঢ়পদ রাখ এবং আমাদেরকে তুমি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কর’ (বাক্বারাহ ২/২৫০)।
জালূত বিরাট সাজ-সজ্জা করে হাতীতে সওয়ার হয়ে
সামনে এসে আস্ফালন করতে লাগল এবং সে যুগের যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রতিপক্ষের
সেরা যোদ্ধাকে আহবান করতে থাকল। অল্পবয়ষ্ক বালক দাঊদ নিজেকে সেনাপতি
তালূতের সামনে পেশ করলেন। তালূত তাকে পাঠাতে রাযী হ’লেন না। কিন্তু দাঊদ
নাছোড় বান্দা। অবশেষে তালূত তাকে নিজের তরবারি দিয়ে উৎসাহিত করলেন এবং
আল্লাহর নামে জালূতের মোকাবিলায় প্রেরণ করলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি এ
ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি জালূতকে বধ করে ফিলিস্তীন পুনরুদ্ধার
করতে পারবে, তাকে রাজ্য পরিচালনায় শরীক করা হবে। অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত
জালূতকে মারা খুবই কঠিন ছিল। কেননা তার সারা দেহ ছিল লৌহ বর্মে আচ্ছাদিত।
তাই তরবারি বা বল্লম দিয়ে তাকে মারা অসম্ভব ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় দাঊদ
ছিলেন পাথর ছোঁড়ায় উস্তাদ। সমবয়সীদের সাথে তিনি মাঠে গিয়ে নিশানা বরাবর
পাথর মারায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। দাঊদ পকেট থেকে পাথর খন্ড বের করে
হাতীর পিঠে বসা জালূতের চক্ষু বরাবর নিশানা করে এমন জোরে মারলেন যে, তাতেই
জালূতের চোখশুদ্ধ মাথা ফেটে মগয বেরিয়ে চলে গেল। এভাবে জালূত মাটিতে
লুটিয়ে পড়লে তার সৈন্যরা পালিয়ে গেল। যুদ্ধে তালূত বিজয় লাভ করলেন। যেমন
আল্লাহ বলেন,
فَهَزَمُوْهُمْ بِإِذْنِ اللهِ
وَقَتَلَ دَاوُودُ جَالُوْتَ وَآتَاهُ اللهُ الْمُلْكَ وَالْحِكْمَةَ
وَعَلَّمَهُ مِمَّا يَشَآءُ وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ
بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الأَرْضُ وَلَـكِنَّ اللهَ ذُوْ فَضْلٍ
عَلَى الْعَالَمِيْنَ-(البقرة ২৫১)-
‘অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করল
এবং দাঊদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাঊদকে দান করলেন রাজ্য ও
দূরদর্শিতা এবং তাকে শিক্ষা দান করলেন, যা তিনি চাইলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ
যদি এভাবে একজনকে অপরজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী ধ্বংস
হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি একান্তই দয়াশীল’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)।
(১) নেতৃত্বের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন হ’ল জ্ঞান ও দৈহিক স্বাস্থ্য, যা তালূতের মধ্যে ছিল।
(২) নেতৃত্বের জন্য বংশ ও অর্থ-সম্পদের চাইতে বড় প্রয়োজন দৃঢ় ঈমান ও আল্লাহর উপরে নির্ভরশীলতা।
(৩) নেতার জন্য অবশ্য কর্তব্য হ’ল কর্মীদের পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করা। যেমন তালূত করেছিলেন।
(৪) চিরকাল সংখ্যালঘু ঈমানদারগণ সংখ্যাগুরু অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে থাকে। যা তালূত ও জালূতের ঘটনায় প্রমাণিত হয়।
(৫) আল্লাহর উপরে নির্ভরশীল, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও
কুশলী সেনাপতি এবং স্বল্পসংখ্যক নিবেদিত প্রাণ লোকই যথেষ্ট হয় বিজয় লাভের
জন্য। তালূত ও দাঊদ যার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।
(৬) অস্ত্রবল ও জনবলের চাইতে ঈমানী বল যেকোন বিজয়ের মূল শক্তি।
(৭) উপরোক্ত ঘটনায় আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে,
তালূত কর্তৃক পরীক্ষা গ্রহণের ফলে তাঁর আমলেই বনু ইস্রাঈলগণের মধ্যে দু’টি
দলের সৃষ্টি হয়। একদল তালূতের অনুগত মুমিন। যারা নিজেদেরকে ‘বনূ ইস্রাঈল’
বলেই পরিচিত করে। অর্থ ‘আল্লাহর দাস’-এর বংশ। অপর দল ছিল মুনাফিক-
যাদেরকে ‘ইয়াহুদী’ বলা হ’ত। প্রকৃত বনু ইস্রাঈলগণ ‘ইয়াহুদী’ নামকে ঘৃণার
সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আজও পৃথিবীতে তারা ঘৃণিত হয়েই আছে। অতদিন
কিয়ামত হবেনা যতদিন না মুসলমানরা একে একে এদেরকে হত্যা করবেন। গাছ ও পাথর
পর্যন্ত এদের পালিয়ে থাকা অবস্থান মুসলমানদের জানিয়ে দেবে।[5]
তালূত ‘আমালেক্বা দখলদারদের হটিয়ে শামের
শাসনকর্তার পদ লাভ করেন। অতঃপর দাঊদ কতদিন পরে নবী হন এবং তালূতের পরে কখন
তিনি শাসনক্ষমতায় আসেন, এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। তবে অন্যান্য
নবীদের ন্যায় তিনি চল্লিশ বছর বয়সে নবুঅত লাভ করেন বলে আমরা ধরে নিতে
পারে। তিনি শতায়ু ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁর পুত্র সন্তানের সংখ্যা
ছিল ১৯ জন। তন্মধ্যে সুলায়মান (আঃ) নবুঅত ও শাসন ক্ষমতা উভয় দিক দিয়ে (নমল ২৭/১৬)
পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। আল্লাহ পিতা ও পুত্রকে অনন্য
বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে সৃষ্টি করেছিলেন। আমরা কুরআন থেকে যা প্রাপ্ত হয়েছি
সেটুকুই পেশ করব সত্যসন্ধানী পাঠকের জন্য। মনে রাখা আবশ্যক যে, কুরআন কোন
গল্পগ্রন্থ নয়। মানুষের হেদায়াতের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই মাত্র
সেখানে পাওয়া যায়। বাকী তথ্যাবলীর উৎস হ’ল ইস্রাঈলী বর্ণনা সমূহ, যার কোন
নির্ভরযোগ্য ভিত্তি নেই। বরং সেখানে অন্যান্য নবীগণের ন্যায় দাঊদ ও
সুলায়মানের চরিত্রকে মসীলিপ্ত করা হয়েছে। আর সেইসব নোংরা কাহিনীকে ভিত্তি
করে আরবী, উর্দূ, ফার্সী এমনকি বাংলা ভাষায়ও লিখিত হয়েছে ‘নবীদের কাহিনী’
নামে বহু বাজে বই-পুস্তিকা। নবীগণের নিষ্পাপত্বে বিশ্বাসী ঈমানদার পাঠকগণ
ঐসব বইপত্র থেকে দূরে থাকবেন, এটাই আমরা একান্তভাবে কামনা করব। বরং আমাদের
পরামর্শ থাকবে, ঐসব উদ্ভট ও নোংরা গল্পগুজবে ভরা তথাকথিত ধর্মীয় (?)
বই-পত্র আগুনে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিন। তাতে নিজের ও পরিবারের এবং
অন্যদের ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে বেঁচে যাবে।
আল্লাহ প্রত্যেক নবীকে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। সেমতে দাঊদ (আঃ)-কে প্রদত্ত বৈশিষ্ট্য সমূহ নিম্নে বিবৃত হ’ল।-
১. আল্লাহ দাঊদ (আঃ)-কে আধ্যাত্মিক ও দৈহিক শক্তিতে বলিয়ান করে সৃষ্টি করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَاذْكُرْ عَبْدَنَا دَاوُودَ ذَا الْأَيْدِ إِنَّهُ أَوَّابٌ-(ص ১৭)- ‘স্মরণ কর, আমার বান্দা দাঊদকে। সে ছিল শক্তিশালী এবং আমার প্রতি সদা প্রত্যাবর্তনশীল’ (ছোয়াদ ৩৮/১৭)।
আয়াতের প্রথমাংশে তাঁর দৈহিক ও দুনিয়াবী শাসন শক্তির কথা বলা হয়েছে এবং
শেষাংশে তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির কথা বলা হয়েছে। এজন্য যে, বিরাট ও
অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাদশাহ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সর্বদা আল্লাহর প্রতি
নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। সকল কাজে তাঁর দিকেই ফিরে যেতেন।
বুখারী ও মুসলিমের এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেন, আল্লাহ তা‘আলার নিকটে সর্বাধিক পসন্দনীয় ছালাত হ’ল দাঊদ (আঃ)-এর
ছালাত এবং সর্বাধিক পসন্দনীয় ছিয়াম ছিল দাঊদ (আঃ)-এর ছিয়াম। তিনি
অর্ধরাত্রি পর্যন্ত ঘুমাতেন। অতঃপর এক তৃতীয়াংশ ছালাতে কাটাতেন এবং শেষ
ষষ্টাংশে নিদ্রা যেতেন। তিনি একদিন অন্তর একদিন ছিয়াম রাখতেন। শত্রুর
মোকাবিলায় তিনি কখনো পশ্চাদপসরণ করতেন না’।[6]
২. পাহাড় ও পক্ষীকুল তাঁর অনুগত ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّا
سَخَّرْنَا الْجِبَالَ مَعَهُ يُسَبِّحْنَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِشْرَاقِ-
وَالطَّيْرَ مَحْشُوْرَةً، كُلٌّ لَّهُ أَوَّابٌ-(ص ১৮-১৯)-
‘আমরা পর্বতমালাকে তার অনুগত করে দিয়েছিলাম। তারা
সকাল-সন্ধ্যায় তার সাথে পবিত্রতা বর্ণনা করত’। ‘আর পক্ষীকুলকেও, যারা তার
কাছে সমবেত হ’ত। সবাই ছিল তার প্রতি প্রত্যাবর্তনশীল’ (ছোয়াদ ৩৮/১৮-১৯)।
একই মর্মে বক্তব্য এসেছে সূরা সাবা ১০ আয়াতে। অন্যদিকে আল্লাহ দাঊদ-পুত্র
সুলায়মানের অধীনস্ত করে দিয়েছিলেন বায়ুকে ও জিনকে। পাহাড় ও পক্ষীকুল হযরত
দাঊদ (আঃ)-এর কিভাবে আনুগত্য করত- সে বিষয়ে কোন বক্তব্য কুরআনে আসেনি।
তাফসীরবিদগণ নানাবিধ সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। আমরা সেগুলিকে এড়িয়ে গেলাম।
কেননা ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন, أَبْهِمُوا مَا أَبْهَمَهُ اللهُ ‘আল্লাহ যে বিষয়কে অস্পষ্ট রেখেছেন, তোমরাও তাকে অস্পষ্ট থাকতে দাও’।[7]
৩, ৪ ও ৫. তাঁকে দেওয়া হয়েছিল সুদৃঢ় সাম্রাজ্য, গভীর প্রজ্ঞা ও অনন্য বাগ্মিতা। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَشَدَدْنَا مُلْكَهُ وَآتَيْنَاهُ الْحِكْمَةَ وَفَصْلَ الْخِطَابِ-(ص ২০)- ‘আমরা তার সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও ফায়ছালাকারী বাগ্মিতা’ (ছোয়াদ ৩৮/২০)। উল্লেখ্য, আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) ও ইমাম শাবী বলেন যে, ‘তিনিই সর্বপ্রথম বক্তৃতায় হাম্দ ও ছালাতের পর أما بعد (‘অতঃপর’) শব্দ যুক্ত করেন’।[8]
পূর্বেই আমরা বলেছি যে, তাঁর এই সাম্রাজ্য ছিল শাম ও ইরাক ব্যাপী। যা
আধুনিক সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ফিলিস্তীন ও ইরাককে শামিল করে। আল্লাহ
বলেন,
يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ
خَلِيْفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا
تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنَّ الَّذِيْنَ
يَضِلُّوْنَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيْدٌ بِمَا نَسُوْا
يَوْمَ الْحِسَابِ-(ص ২৬)-
‘হে দাঊদ! আমরা তোমাকে পৃথিবীতে খলীফা করেছি।
অতএব তুমি মানুষের মাঝে ন্যায়সঙ্গত ফায়ছালা কর এবং খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর
না। তাহ’লে তা তোমাকে আল্লাহর পথ হ’তে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর
পথ হ’তে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি এ কারণে যে, তারা
হিসাব দিবসকে ভুলে যায়’ (ছোয়াদ ৩৮/২৬)।
৬. লোহাকে আল্লাহ তাঁর জন্য নরম করে দিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ آتَيْنَا دَاوُودَ مِنَّا
فَضْلاً يَا جِبَالُ أَوِّبِيْ مَعَهُ وَالطَّيْرَ وَأَلَنَّا لَهُ
الْحَدِيْدَ- أَنِ اعْمَلْ سَابِغَاتٍ وَقَدِّرْ فِي السَّرْدِ
وَاعْمَلُوْا صَالِحاً إِنِّيْ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ- (سبا
১০-১১)-
‘...এবং
আমরা তার জন্য লোহাকে নরম করে দিয়েছিলাম’ ‘এবং তাকে বলেছিলাম প্রশস্ত
বর্ম তৈরী কর ও কড়াসমূহ যথাযথভাবে সংযুক্ত কর এবং তোমরা সৎকর্ম সম্পাদন
কর। তোমরা যা কিছু কর, তা আমরা দেখে থাকি’ (সাবা ৩৪/১০-১১)।
উল্লেখ্য যে, হযরত দাঊদ (আঃ) একজন দক্ষ কর্মকার
ছিলেন। বিশেষ করে শত্রুর মোকাবিলার জন্য উন্নত মানের বর্ম নির্মাণে তিনি
ছিলেন একজন কুশলী কারিগর। যা বিক্রি করে তিনি সংসার যাত্রা নির্বাহ করতেন।
রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিজের ভরণপোষণের জন্য কিছুই নিতেন না। যদিও সেটা
নেওয়া কোন দোষের ছিল না। এখানে লোহাকে বাস্তবে মোমের মত নরম করার
প্রকাশ্য অর্থ নিলে সেটা হবে তাঁর জন্য মু‘জেযা স্বরূপ, যা মোটেই অসম্ভব
নয়। অবশ্য নরম করে দেওয়ার অর্থ লোহাকে সহজে ইচ্ছামত রূপ দেওয়ার ও
উন্নতমানের নির্মাণ কৌশল শিক্ষাদানও হ’তে পারে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলে