ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ): ইমাম, হাফিয, ফাকীহ, মুজতাহিদ, মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, মুজাহিদ …
‘তাইমিয়্যাহ’ নামটি ছিল একজন
পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিদ্বান মুসলিমাহ্ নারীর। তাঁর বংশ পরম্পরায় অনেকেই ছিলেম
বিদ্বান আলেম, কিন্তু তাঁদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি খ্যাতনামা ছিলেন তিনি
হলেন ইবনে তাইমিয়্যাহ। ইবনে তাইমিয়্যাহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন
বিধায় তিনি এই উপাধি অর্জন করেন। তাঁর মাতামহ তাইমিয়্যাহ রেখে গেছেন বহু
অবদান। ইসলামের জন্য এই পরিবারের রয়েছে এক বিস্ময়কর খেদমতের ইতিহাস।
তাঁর এই অসাধারণ অবদানকে সংক্ষেপে ফুটিয়ে তোলার জন্য উল্লেখযোগ্য একটি উদাহরণ নিম্নে উল্লেখ করা হল:
তাতারী কর্তৃক ইরাক আগ্রাসনের সময়কার ঘটনা
এটি। তাতারীদের আক্রমণের ভয়ে ও আতংকে মানুষজন তাদের ঘর-বাড়ি, বাসস্থান,
দেশ সবকিছু ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে লাগল। মাত্রই ঘটে গেল তাতারীদের
দ্বারা বাগদাদের ইসলামিক গ্রন্থাগারটি সম্পূর্ণরূপে পুড়ে ফেলার ঘটনাটি।
যদিও ইবনে তাইমিয়্যাহ তখন ছোট্ট একটি শিশু ছিলেন; কিন্তু তাঁর পিতামহ,
পিতা, এবং চাচা-মামারা ছিলেন ওলামা-মাশায়েখ। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তারাও
দেশত্যাগ করবেন। কিন্তু তারা তাদের সাথে তেমন কোন দ্রব্যাদি-জিনিসপত্র
নিলেন না বরং তাদের অধিগ্রহণে থাকা সবগুলো ইসলামিক বই একটি ঝুলিতে পুরলেন
এবং এই অত্যন্ত ভারি ঝুলিটি নিজ হাতে বয়ে নিয়ে চললেন।
এই বইগুলোই ইবনে তাইমিয়্যাহ উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন।
তাঁর মাধ্যমেই আমরা আজও দ্বীনের বিস্ময়কর (প্রকৃত) জ্ঞান উদ্ধার করতে
সক্ষম হচ্ছি। পরবর্তীতে, ঐ বেঁচে যাওয়া বইগুলোর মাধ্যমেই ইবনে তাইমিয়্যাহ
জ্ঞান অর্জন করেন এবং তাঁর ৬৭ বছরের জীবনকালে লিখে গিয়েছেন ৫৯১ টি পুস্তক। ইবনে তাইমিয়্যাহ’র ছাত্রদের মধ্য থেকে মুসলিম বিশ্ব পেয়েছে তিনজন জগদ্বিখ্যাত আলেম। তারা হলেন ইবনে কাসীর, ইবনুল কায়্যিম জাওযী, এবং যাহাবী। জ্ঞান ও জ্ঞানের পণ্ডিত: এ দুটি জিনিস হল তা, যা ইবনে তাইমিয়্যাহ আমাদের মাঝে রেখে গেছেন।
বাস্তবিক অর্থে, অত্যন্ত শৈশবকাল থেকে
ইবনে তাইমিয়্যাহ তাঁর পিতামহ, পিতা ও চাচাদের মত বড় বড় আলেম-ওলামাদের
সাহচর্যে লালিত-পালিত হওয়ার কারণেই জ্ঞান ও ইসলাম সম্পর্কে দীক্ষা নেওয়ার
স্পৃহা অর্জন করেন। বলা যেতে পারে, তাঁর জীবনের এই অংশটুকু নিখুঁত সময় ব্যবস্থাপনার একটি অনন্য উদাহরণ।
একদা ইবনে তাইমিয়্যাহর পিতা সকল বাচ্চাদের নিয়ে একটি বাগানে বেড়াতে গেলেন
কিন্তু ইবনে তাইমিয়্যাহ তাদের সাথে গেলেন না। যখন তাঁর বাবা ফিরে এলেন তখন
ইবনে তাইমিয়্যাহ তাঁর বাবাকে বললেন যে, সে সময়ের মধ্যে তিনি একটি পুরো বই
মুখস্ত (আয়ত্ব) করে ফেলেছেন।
ইবনে তাইমিয়্যাহকে কারাগার বরণ করতে হয়েছিল তিনবার,
এবং প্রত্যেকবারই তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল কিছু নামসর্বস্ব মুসলিম কর্তৃক
সেইসময়কার শাসকবর্গের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার কারণে। তাঁর প্রথম
কারাবন্দিত্ব ছিল গৃহবন্দিত্বের মত, যেখানে যে কেউ (মানুষজন) এসে উনার সাথে
দেখা-সাক্ষাত করতে পারত কিন্তু উনি কোথাও যেতে পারতেন না। এই সময়টুকুতে
উনি উনার পরকালের পুঁজি সংগ্রহ করতে থাকেন মানুষকে আদেশ-নসিহাত এবং ফতওয়া
দিয়ে। দ্বিতীয়বার যখন উনাকে বন্দি করা হয় তখন উনাকে কারাগারে থাকতে হয়
প্রায় এক বছরের মত।
ইত্যবসরে তিনি লক্ষ্য করেন যে মুসলিমদের
অন্তরে বিভিন্ন মিথ্যা, বানোয়াট ও ভ্রান্ত ধারনার অনুপ্রবেশ ইসলামিক আকীদা
বিশ্বাসকে কলুষিত ও বিকৃত করে তুলছে। এই সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাওহিদ বিষয়ক একটি বই লিখেন যার নাম “আল আকিদাতুল ওয়াসিতিয়্যাহ” (Al Aqeedatul Wasitiyah),
যা পরবর্তীতে পরিণত হয় অন্যতম বিখ্যাত একটি ইসলামিক শিল্পকর্মে। তিনি বইটি
লিখা শুরু করেন আসরের নামাযের পর থেকে এবং মাগরিবের ওয়াক্ত হতে হতেই তিনি
বইটি পুরো লিখে ফেলেন! আপনি যদি বইটি পড়েন তবে দেখতে ভুলবেন না যে, তিনি
অসাধারণ দক্ষতায় বইটির প্রত্যেকটি বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে কুরআন মাজিদের
বিভিন্ন আয়াতকে দলিল হিসেবে প্রয়োগ করেন। আসর থেকে মাগরিবের মধ্যকার আড়াই
ঘণ্টার এই স্বল্প সময়ে এবং কুরআন মাজিদের অসংখ্য আয়াতকে দলিল হিসেবে
ব্যবহার করে লেখা এই বইটি তাঁর কুরআনের উপর অসাধারণ দক্ষতা ও সুগভীর
জ্ঞানের প্রমাণ বহন করে। তিনি শুধু সত্য ও হক্ব নিয়েই লেখেননি, পাশাপাশি
মিথ্যা ও বাতিলের বিরুদ্ধে কথা বলা ও লেখার মাধ্যমে এর বিলুপ্তি ঘটান।
তিনি যখন জেলে থাকা অবস্থায় মারা গেলেন তখন জেলের মুয়াজ্জিন প্রাচিরের উপর উঠে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ ঘোষণা করেন। এরপর তাঁকে সমাধিস্থ করার সময় প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করেন
এবং তাঁর জন্য দু’আ করেন। ঐ যুগে ফেসবুক, টুইটার, বা হোয়াটসঅ্যাপ নামক
মাধ্যমগুলো না থাকার পরেও কিভাবে অতিদ্রুত তাঁর মৃত্যুর সংবাদ দূর-দুরান্তে
ছড়িয়ে পড়লো তা চিন্তা করলেই বিস্মিত হতে হয়।
এই যুগে আমাদের জীবন পুরোপুরি যান্ত্রিক
এবং প্রযুক্তিনির্ভর; আমাদের কর্ম ও উৎপাদনশীলতা হল যন্ত্র ও প্রযুক্তির
মেজাজ-মর্জির উপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তির চাকা ঘুরলে আমাদের জীবন চাকাও
ঘূর্ণায়মান থাকে আর প্রযুক্তির চাকা থেমে গেলে আমাদের জীবনও থেমে যায়।
যেমন: ওয়াশিং মেশিন, ঘড়ি, মোবাইল, গাড়ি, রান্নার ওভেন এগুলোর ঠিকঠাক মত কাজ
করার উপরে আমাদের দৈনন্দিন জীবন নির্ভর করে, আর এগুলো যদি ঠিকঠাক কাজ না
করে তবে দেখা যায় দিনশেষে আমাদের কিছুই করা হয়ে উঠেনি। অথচ ঐ যুগে এসবের
কিছুই ছিল না, কম্পিউটার যেমন দ্রুত টাইপ করতে পারে তেমন অতিদ্রুত লেখতে
পারে এরকম কোন লেখকও ছিল না, তারপরেও ইবনে তাইমিয়্যাহ প্রায় ৩ লক্ষ পৃষ্ঠার মত রচনা লিখে গিয়েছেন। আর অপরদিকে দেখা যায় যে আমাদের দিনে নিছক ১০টা পৃষ্ঠাও মনোযোগ দিয়ে পড়া হয়ে উঠে না।
আমরা প্রচুর সময় অপব্যয় করি, আর শুধু সময়
স্বল্পতার অভিযোগ আনি। অথচ ইবনে তাইমিয়্যাহ সময়কে অত্যন্ত বিজ্ঞতার সহিত
ব্যবহার করতেন তাঁর মাল্টি-টাস্কিং (অনেকগুলো কাজ একই সাথে করতে পারা) করার
ক্ষমতার মাধ্যমে; যেমন তিনি এক বৈঠকে একই সাথে ৬০ পৃষ্ঠার ইসলামিক
রচনা লিখা, ৩৫ ভলিউমের সমপরিমাণ ফাতাওয়া কম্পাইল (বিন্যস্ত) করা, এবং এক
দল ছাত্রকে দেখাশোনা করা ও তাদের কুরআন ও হাদিস শিক্ষা দিতে পারতেন।
তিনি তাঁর কারাগারে বন্দিত্বের জীবনকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিলেন এবং এই সময়
তিনি পূর্ণ কুরআন মাজিদ ৮০ বারের মত অধ্যয়ন করেন। জীবনে কোনদিন সময়
ব্যবস্থাপনা, গঠনমূলক চিন্তাচেতনা, অথবা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির উপর কোন
ধরনের কর্মশালায় অংশগ্রহণ না করেও শুধুমাত্র কুরআন অধ্যয়নের প্রতি
অনুরক্ততার (আত্মিক সংযোজন) মাধ্যমে এমন এক প্রশিক্ষণ লাভ করেন যা বর্তমান
বিশ্বের কোন উঁচুদরের প্রশিক্ষক দিতে পারবে না।
এমনই এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইবনে তাইমিয়্যাহ
রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম, হাফিয, ফাকীহ, মুজতাহিদ, মুফাস্সির, মুহাদ্দিস,
মুজাহিদ। আল্লাহ যেন তাঁর উপর অফুরন্ত রহমত বর্ষণ করেন।
source: muslimmedia.info