আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির
মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, লূত্ব ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ষষ্ঠ
গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসাবে কওমে ফেরাঊন সম্পর্কে আল্লাহ পাক কুরআনের ২৭টি
সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন।[1]
কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হ’ল এটি। যাতে ফেরাঊনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ও
তার যুলুমের নীতি-পদ্ধতি সমূহ পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় এবং এযুগের
ফেরাঊনদের বিষয়ে উম্মতে মুহাম্মাদী হুঁশিয়ার হয়। ফেরাঊনের কাছে প্রেরিত
নবী মূসা ও হারূণ (আঃ) সম্পর্কে কুরআনে সর্বাধিক আলোচনা স্থান পেয়েছে।
কারণ মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযা সমূহ অন্যান্য নবীদের তুলনায় যেমন বেশী ছিল,
তাঁর সম্প্রদায় বনী ইস্রাঈলের মূর্খতা ও হঠকারিতার ঘটনাবলীও ছিল বিগত
উম্মতগুলির তুলনায় অধিক এবং চমকপ্রদ। এতদ্ব্যতীত মূসা (আঃ)-কে বারবার
পরীক্ষা নেবার মধ্যে এবং তাঁর কওমের দীর্ঘ কাহিনীর আলোচনা প্রসঙ্গে বহু
জ্ঞাতব্য বিষয় ও আদেশ-নিষেধের কথাও এসেছে। সর্বোপরি শাসক সম্রাট ফেরাঊন ও
তার ক্বিবতী সম্প্রদায় কর্তৃক সংখ্যালঘু অভিবাসী বনু ইস্রাঈল সম্প্রদায়ের
উপর যুলুম-অত্যাচারের বিবরণ ও তার প্রতিরোধে মূসা (আঃ)-এর প্রচেষ্টা এবং
দীর্ঘ বিশ বছর ধরে যালেম সম্প্রদায়ের উপরে আপতিত বিভিন্ন গযবের বর্ণনা ও
অবশেষে ফেরাঊনের সদলবলে সলিল সমাধির ঘটনা যেন জীবন্ত বাণীচিত্র হয়ে ফুটে
উঠেছে বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত কুরআনের অনুপম বাকভঙ্গীতে। মোটকথা কুরআন পাক
মূসা (আঃ)-এর কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছে যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না
কিছু বর্ণিত হয়েছে। কারণ এই কাহিনীতে অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার
শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্য সমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এগুলোতে
কর্মোদ্দীপনা ও চারিত্রিক সংশোধনের নির্দেশিকা সমূহ প্রচুর পরিমাণে
বিদ্যমান রয়েছে।
মূসা (আঃ) ও ফেরাঊনের ঘটনা কুরআনে বারবার উল্লেখ
করার অন্যতম উদ্দেশ্য হ’ল, এলাহী কিতাবধারী ইহুদী-নাছারাদের পিছনের কথা
স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং শেষনবীর উপরে ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন
করা। উল্লেখ্য যে, পরবর্তী রাসূল দাঊদ, সুলায়মান ও ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) সবাই ছিলেন বনু ইস্রাঈল-এর সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তাদের প্রতি প্রেরিত নবী। মূসা (আলাইহিস সালাম) ছিলেন এঁদের সবার মূল ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
উল্লেখ্য যে, কওমে মূসা ও ফেরাঊন সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের মোট ৪৪টি সূরায় ৫৩২টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[2]
‘ফেরাঊন’ কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হ’ল তৎকালীন
মিসরের সম্রাটদের উপাধি। ক্বিবতী বংশীয় এই সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দী ব্যাপী
মিসর শাসন করেন। এই সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ
মমিকরণ, পিরামিড (PYRAMID), স্ফিংক্স (SPHINX) প্রভৃতি তাদের সময়কার
বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে। হযরত মূসা (আঃ)-এর সময়ে পরপর দু’জন
ফেরাঊন ছিলেন। সর্বসম্মত ইস্রাঈলী বর্ণনাও হ’ল এটাই এবং মূসা (আঃ)
দু’জনেরই সাক্ষাৎ লাভ করেন। লুইস গোল্ডিং (LOUIS GOLDING)-এর
তথ্যানুসন্ধানমূলক ভ্রমণবৃত্তান্ত IN THE STEPS OF MOSSES, THE LAW GIVER
অনুযায়ী উক্ত ‘উৎপীড়ক ফেরাঊন’-এর (PHARAOH, THE PERSECUTOR) নাম ছিল
‘রেমেসিস-২’ (RAMSES-11) এবং ডুবে মরা ফেরাঊন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ (منفطه)
বা মারনেপতাহ (MERNEPTAH)। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হরদে তিনি সসৈন্যে
ডুবে মরেন। যার ‘মমি’ ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয়। সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিম তীরে
‘জাবালে ফেরাঊন’ নামে একটি ছোট পাহাড় আছে। এখানেই ফেরাঊনের লাশ প্রথম
পাওয়া যায় বলে জনশ্রুতি আছে। গোল্ডিংয়ের ভ্রমণ পুস্তক এবং এনসাইক্লোপেডিয়া
ব্রিটানিকার নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, ‘থেব্স’ (THEBES) নামক স্থানের সমাধি
মন্দিরে ১৮৯৬ সালে একটি স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়, যাতে মারনেপতাহ-এর আমলের
কীর্তি সমূহ লিপিবদ্ধ ছিল। অতঃপর ১৯০৬ সালে বৃটিশ নৃতত্ত্ববিদ স্যার
ক্রাঁফো ইলিয়ট স্মিথ (SIR CRAFTON ELLIOT SMITH) মমিগুলো খুলে মমিকরণের
কলাকৌশল অনুসন্ধান শুরু করেন। এভাবে তিনি ৪৪টি মমি পরীক্ষা করেন এবং
অবশেষে ১৯০৭ সালে তিনি ফেরাঊন মারনেপতাহ-এর লাশ শনাক্ত করেন। ঐসময় তার
লাশের উপরে লবণের একটি স্তর জমে ছিল। যা দেখে সবাই স্তম্ভিত হন। এ কারণে
যে, অন্য কোন মমি দেহে অনুরূপ পাওয়া যায়নি।[3]
উক্ত লবণের স্তর যে সাগরের লবণাক্ত পানি তা বলাই বাহুল্য। এভাবে সূরা
ইউনুস ৯২ আয়াতের বক্তব্য দুনিয়াবাসীর নিকটে সত্য প্রমাণিত হয়ে যায়। যেখানে
আল্লাহ বলেছিলেন যে, ‘আজকে আমরা তোমার দেহকে (বিনষ্ট হওয়া থেকে) বাঁচিয়ে
দিলাম। যাতে তুমি পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত হ’তে পার’... (ইউনুস ১০/৯২)। বস্ত্ততঃ ফেরাঊনের লাশ আজও মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে। যা দেখে লোকেরা উপদেশ হাছিল করতে পারে।
মূসা ও ফেরাঊন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
نَتْلُوا عَلَيْكَ مِن نَّبَإِ مُوسَى
وَفِرْعَوْنَ بِالْحَقِّ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ- إِنَّ فِرْعَوْنَ عَلاَ
فِي الْأَرْضِ وَجَعَلَ أَهْلَهَا شِيَعاً يَسْتَضْعِفُ طَائِفَةً
مِّنْهُمْ يُذَبِّحُ أَبْنَاءَهُمْ وَيَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ إِنَّهُ
كَانَ مِنَ الْمُفْسِدِيْنَ- (القصص ৩-৪)-
‘আমরা আপনার নিকটে মূসা ও ফেরাঊনের বৃত্তান্ত সমূহ
থেকে সত্য সহকারে বর্ণনা করব বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য’। ‘নিশ্চয়ই ফেরাঊন
তার দেশে উদ্ধত হয়েছিল এবং তার জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল। তাদের
মধ্যকার একটি দলকে সে দুর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা
করত ও কন্যা সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখত। বস্ত্ততঃ সে ছিল অনর্থ
সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (ক্বাছাছ ২৮/৩-৪)।
পবিত্র কুরআনে ফেরাঊনের আলোচনা যত এসেছে, পূর্ব
যুগের অন্য কোন নরপতি সম্পর্কে এত বেশী আলোচনা আসেনি। এর মাধ্যমে ফেরাঊনী
যুলুমের বিভিন্ন দিক স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যাতে ইঙ্গিত রয়েছে এ
বিষয়ে যে, যুগে যুগে ফেরাঊনরা আসবে এবং ঈমানদার সৎকর্মশীলদের উপরে তাদের
যুলুমের ধারা ও বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রূপ হবে। যদিও পদ্ধতি পরিবর্তিত হবে।
কোন যুগই ফেরাঊন থেকে খালি থাকবে না। তাই ফেরাঊন সম্পর্কে সম্যক ধারণা
দেওয়ার জন্য আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এই নরাধম সম্পর্কে এত বেশী আলোচনা
করেছেন। যাতে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা সাবধান হয় এবং যালেমদের ভয়ে আল্লাহর
পথ থেকে বিচ্যুত না হয়। মুসলিম নামধারী বর্তমান মিসরীয় জাতীয়তাবাদী নেতারা
ফেরাঊনকে তাদের ‘জাতীয় বীর’ বলে আখ্যায়িত করছেন এবং কায়রোর ‘ময়দানে
রেমেসীস’-এর প্রধান ফটকে তার বিশাল প্রস্তর মূর্তি খাড়া করেছেন’।[4]
হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র হযরত ইসহাক্ব
(আঃ)-এর পুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’। হিব্রু ভাষায়
‘ইস্রাঈল’ অর্থ ‘আল্লাহর দাস’। সে হিসাবে ইয়াকূব (আঃ)-এর বংশধরগণকে ‘বনু
ইস্রাঈল’ বলা হয়। কুরআনে তাদেরকে ‘বনু ইস্রাঈল’ বলে অভিহিত করা হয়েছে,
যাতে ‘আল্লাহর দাস’ হবার কথাটি তাদের বারবার স্মরণে আসে।
ইয়াকূব (আঃ) ও বনু ইস্রাঈলদের আদি বাসস্থান ছিল
কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তীন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তীন ও
সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। বলা চলে যে, প্রথম ও শেষনবী ব্যতীত প্রায়
সকল নবীর আবাসস্থল ছিল ইরাক ও শাম অঞ্চলে। যার গোটা অঞ্চলকে এখন
‘মধ্যপ্রাচ্য’ বলা হচ্ছে। ইয়াকূব (আঃ)-এর পুত্র হযরত ইউসুফ (আঃ) যখন
মিসরের অর্থমন্ত্রী ও পরে শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের
ন্যায় কেন‘আন অঞ্চলেও চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর
আমন্ত্রণে পিতা ইয়াকূব (আঃ) স্বীয় পুত্রগণ ও পরিবারবর্গ সহ হিজরত করে
মিসরে চলে যান। ক্রমে তাঁরা সেখানে আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখে-শান্তিতে
দিনাতিপাত করতে থাকেন। তারীখুল আম্বিয়া-র লেখক বলেন, ইউসুফ (আঃ)-এর
কাহিনীতে কোথাও ফেরাঊনের নাম উল্লেখ না থাকায় প্রমাণিত হয় যে, ঐ সময়
ফেরাঊনদের হটিয়ে সেখানে ‘হাকসূস’ (ملوك الهكسوس ) রাজাদের রাজত্ব কায়েম হয়। যারা দু’শো বছর রাজত্ব করেন এবং যা ছিল ঈসা (আঃ)-এর জন্মের প্রায় দু’হাযার বছর আগের ঘটনা।[5]
অতঃপর মিসর পুনরায় ফেরাঊনদের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর
পরে তাঁর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারূনের সময় যে নিপীড়ক ফেরাঊন শাসন
ক্ষমতায় ছিল তার নাম ছিল রেমেসীস-২। অতঃপর তার পুত্র মারনেপতাহ-এর সময়
সাগরডুবির ঘটনা ঘটে এবং সৈন্য-সামন্ত সহ তার সলিল সমাধি হয়।
‘ফেরাঊন’ ছিল মিসরের ক্বিবতী বংশীয় শাসকদের উপাধি।
ক্বিবতীরা ছিল মিসরের আদি বাসিন্দা। এক্ষণে তারা সম্রাট বংশের হওয়ায় শাম
থেকে আগত সুখী-স্বচ্ছল বনু ইস্রাঈলদের হিংসা করতে থাকে। ক্রমে তা সামাজিক ও
রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের রূপ পরিগ্রহ করে।
এক বর্ণনায় এসেছে যে, ইয়াকূবের মিসরে আগমন থেকে
মূসার সাথে মিসর থেকে বিদায়কালে প্রায় চারশত বছর সময়ের মধ্যে তাদের সংখ্যা
দাঁড়িয়েছিল কাছাকাছি প্রায় তিন মিলিয়ন[6] এবং এ সময় তারা ছিল মিসরের মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ শতাংশ’।[7] তবে এগুলি সবই ইস্রাঈলীদের কাল্পনিক হিসাব মাত্র। যার কোন ভিত্তি নেই’। বরং কুরআন বলছে إِنَّ هَؤُلآء لَشِرْذِمَةٌ قَلِيلُونَ- (الشعراء ৫৪)- ‘নিশ্চয়ই তারা ছিল ক্ষুদ্র একটি দল’ (শো‘আরা ২৬/৫৪)।
এই বহিরাগত নবী বংশ ও ক্ষুদ্র দলের সুনাম-সুখ্যাতিই ছিল সংখ্যায় বড় ও
শাসকদল ক্বিবতীদের হিংসার কারণ। এরপর জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী ফেরাঊনকে
ভীত ও ক্ষিপ্ত করে তোলে।
موسى بن عمران بن قاهث بن عازر بن لاوى بن يعقوب بن اسحاق بن ابراهيم عليهم السلام-
মূসা ইবনে ইমরান বিন ক্বাহেছ বিন ‘আযের বিন লাভী বিন ইয়াকূব বিন ইসহাক্ব বিন ইবরাহীম (আঃ)।[8]
অর্থাৎ মূসা হ’লেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। মূসা (আঃ)-এর পিতার
নাম ছিল ‘ইমরান’ ও মাতার নাম ছিল ‘ইউহানিব’। তবে মায়ের নামের ব্যাপারে
মতভেদ আছে।[9]
উল্লেখ্য যে, মারিয়াম (আঃ)-এর পিতার নামও ছিল ‘ইমরান’। যিনি ছিলেন হযরত
ঈসা (আঃ)-এর নানা। মূসা ও ঈসা উভয় নবীই ছিলেন বনু ইস্রাঈল বংশীয় এবং উভয়ে
বনু ইস্রাঈলের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন (সাজদাহ ৩২/২৩, ছফ ৬১/৬)।
মূসার জন্ম হয় মিসরে এবং লালিত-পালিত হন মিসর সম্রাট ফেরাঊনের ঘরে। তাঁর
সহোদর ভাই হারূণ (আঃ) ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড় এবং তিনি মূসা (আঃ)-এর
তিন বছর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শাম-এর
মধ্যবর্তী তীহ্ প্রান্তরে বনু ইস্রাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে।
মাওলানা মওদূদী বলেন, মূসা (আঃ) পঞ্চাশ বছর বয়সে নবী হয়ে ফেরাঊনের দরবারে
পৌঁছেন। অতঃপর তেইশ বছর দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের পর ফেরাঊন ডুবে মরে এবং বনু
ইস্রাঈল মিসর থেকে বেরিয়ে যায়। এ সময় মূসা (আঃ)-এর বয়স ছিল সম্ভবতঃ আশি
বছর।[10]
তবে মুফতী মুহাম্মাদ শফী বলেন, ফেরাঊনের জাদুকরদের সাথে মুকাবিলার ঘটনার
পর ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী মূসা (আঃ) বিশ বছর যাবত মিসরে অবস্থান করেন। এ
সময় আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে নয়টি মু‘জেযা দান করেন।
উল্লেখ্য যে, আদম, ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আঃ) ব্যতীত প্রায়
সকল নবীই চল্লিশ বছর বয়সে নবুঅত লাভ করেছিলেন। মূসাও চল্লিশ বছর বয়সে
নবুঅত লাভ করেছিলেন বলে অধিকাংশ বিদ্বান মত পোষণ করেছেন।[11]
সেমতে আমরা মূসা (আঃ)-এর বয়সকে নিম্নরূপে ভাগ করতে পারি। যেমন, প্রথম ৩০
বছর মিসরে, তারপর ১০ বছর মাদিয়ানে, তারপর মিসরে ফেরার পথে তূর পাহাড়ের
নিকটে ‘তুবা’ (طُوَى)
উপত্যকায় ৪০ বছর বয়সে নবুঅত লাভ। অতঃপর ২০ বছর মিসরে অবস্থান করে
সেখানকার অধিবাসীদেরকে তাওহীদের দাওয়াত প্রদান। তারপর ৬০ বছর বয়সে বনু
ইস্রাঈলদের নিয়ে মিসর হ’তে প্রস্থান এবং ফেরাঊনের সলিল সমাধি। অতঃপর আদি
বাসস্থান কেন‘আন অধিকারী আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে জিহাদের হুকুম অমান্য করায়
অবাধ্য ইস্রাঈলীদের নিয়ে ৪০ বছর যাবত তীহ্ প্রান্তরে উন্মুক্ত কারাগারে
অবস্থান ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের সন্নিকটে মৃত্যু সম্ভবতঃ ৮০ থেকে ১০০ বছর
বয়সের মধ্যে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। আমাদের
নবী (ছাঃ) সেখানে একটি লাল ঢিবির দিকে ইশারা করে সেস্থানেই মূসা (আঃ)-এর
কবর হয়েছে বলে জানিয়েছেন।[12]
উল্লেখ্য যে, আদম (আঃ) থেকে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ১০/১২ জন নবী বাদে
শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীতে আগত সর্বমোট এক
লক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূলের[13]
প্রায় সবাই ইস্রাঈল বংশের ছিলেন এবং তাঁরা ছিলেন সেমেটিক। কেননা ইব্রাহীম
(আঃ) ছিলেন সাম বিন নূহ-এর ৯ম অধঃস্তন পুরুষ। এজন্য ইবরাহীমকে ‘আবুল
আম্বিয়া’ বা নবীদের পিতা বলা হয়।
সুদ্দী ও মুররাহ প্রমুখ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস ও
আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) এবং বহু সংখ্যক ছাহাবী থেকে বর্ণনা করেন যে,
ফেরাঊন একদা স্বপ্নে দেখেন যে, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিক হ’তে একটি আগুন
এসে মিসরের ঘর-বাড়ি ও মূল অধিবাসী ক্বিবতীদের জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অথচ
অভিবাসী বনু ইস্রাঈলদের কিছুই হচ্ছে না। ভীত-চকিত অবস্থায় তিনি ঘুম থেকে
জেগে উঠলেন। অতঃপর দেশের বড় বড় জ্যোতিষী ও জাদুকরদের সমবেত করলেন এবং
তাদের সম্মুখে স্বপ্নের বৃত্তান্ত বর্ণনা দিলেন ও এর ব্যাখ্যা জানতে
চাইলেন। জ্যোতিষীগণ বলল যে, অতি সত্বর বনু ইস্রাঈলের মধ্যে একটি পুত্র
সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। যার হাতে মিসরীয়দের ধ্বংস নেমে আসবে’।[14]
মিসর সম্রাট ফেরাঊন জ্যোতিষীদের মাধ্যমে যখন জানতে
পারলেন যে, অতি সত্বর ইস্রাঈল বংশে এমন একটা পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে,
যে তার সাম্রাজ্যের পতন ঘটাবে। তখন উক্ত সন্তানের জন্ম রোধের কৌশল হিসাবে
ফেরাঊন বনু ইস্রাঈলদের ঘরে নবজাত সকল পুত্র সন্তানকে ব্যাপকহারে হত্যার
নির্দেশ দিল। উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে হত্যা করতে থাকলে এক সময় বনু ইস্রাঈল
কওম যুবক শূন্য হয়ে যাবে। বৃদ্ধরাও মারা যাবে। মহিলারা সব দাসীবৃত্তিতে
বাধ্য হবে। অথচ বনু ইস্রাঈলগণ ছিল মিসরের শাসক শ্রেণী এবং উচ্চ মর্যাদা
সম্পন্ন জাতি। এই দূরদর্শী কপট পরিকল্পনা নিয়ে ফেরাঊন ও তার মন্ত্রীগণ
সারা দেশে একদল ধাত্রী মহিলা ও ছুরিধারী জাল্লাদ নিয়োগ করে। মহিলারা বাড়ী
বাড়ী গিয়ে বনু ইস্রাঈলের গর্ভবতী মহিলাদের তালিকা করত এবং প্রসবের দিন
হাযির হয়ে দেখত, ছেলে না মেয়ে। ছেলে হ’লে পুরুষ জাল্লাদকে খবর দিত। সে এসে
ছুরি দিয়ে মায়ের সামনে সন্তানকে যবহ করে ফেলে রেখে চলে যেত।[15]
এভাবে বনু ইস্রাঈলের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেল। ইবনু কাছীর বলেন,
একাধিক মুফাসসির বলেছেন যে, শাসকদল ক্বিবতীরা ফেরাঊনের কাছে গিয়ে অভিযোগ
করল যে, এভাবে পুত্র সন্তান হত্যা করায় বনু ইস্রাঈলের কর্মজীবী ও শ্রমিক
শ্রেণীর ঘাটতি হচ্ছে। যাতে তাদের কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে। তখন ফেরাঊন এক
বছর অন্তর অন্তর পুত্র হত্যার নির্দেশ দেয়। এতে বাদ পড়া বছরে হারূণের জন্ম
হয়। কিন্তু হত্যার বছরে মূসার জন্ম হয়।[16]
ফলে পিতা-মাতা তাদের নবজাত সন্তানের নিশ্চিত হত্যার আশংকায় দারুণভাবে ভীত
হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ মূসা (আঃ)-এর মায়ের অন্তরে ‘ইলহাম’ করেন।
যেমন আল্লাহ পরবর্তীতে মূসাকে বলেন,
وَلَقَدْ مَنَنَّا عَلَيْكَ مَرَّةً
أُخْرَى- إِذْ أَوْحَيْنَا إِلَى أُمِّكَ مَا يُوحَى- أَنِ اقْذِ فِيهِ
فِي التَّابُوتِ فَاقْذِ فِيهِ فِي الْيَمِّ فَلْيُلْقِهِ الْيَمُّ
بِالسَّاحِلِ يَأْخُذْهُ عَدُوٌّ لِّي وَعَدُوٌّ لَّهُ وَأَلْقَيْتُ
عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِّنِّي وَلِتُصْنَعَ عَلَى عَيْنِي- (طه ৩৭-৩৯)-
‘আমরা
তোমার উপর আরো একবার অনুগ্রহ করেছিলাম’। ‘যখন আমরা তোমার মাকে প্রত্যাদেশ
করেছিলাম, যা প্রত্যাদেশ করা হয়’। ‘(এই মর্মে যে,) তোমার নবজাত সন্তানকে
সিন্দুকে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দাও’। ‘অতঃপর নদী তাকে তীরে ঠেলে দেবে। অতঃপর
আমার শত্রু ও তার শত্রু (ফেরাঊন) তাকে উঠিয়ে নেবে এবং আমি তোমার উপর আমার
পক্ষ হ’তে বিশেষ মহববত নিক্ষেপ করেছিলাম এবং তা এজন্য যে, তুমি আমার চোখের
সামনে প্রতিপালিত হও’ (ত্বোয়াহা ২০/৩৭-৩৯)। বিষয়টি আল্লাহ অন্যত্র বলেন এভাবে,
وَأَوْحَيْنَا إِلَى أُمِّ مُوسَى أَنْ
أَرْضِعِيْهِ فَإِذَا خِفْتِ عَلَيْهِ فَأَلْقِيْهِ فِي الْيَمِّ وَلاَ
تَخَافِي وَلاَ تَحْزَنِي إِنَّا رَادُّوهُ إِلَيْكِ وَجَاعِلُوهُ مِنَ
الْمُرْسَلِينَ- (القصص ৭)-
‘আমরা
মূসার মায়ের কাছে প্রত্যাদেশ করলাম এই মর্মে যে, তুমি ছেলেকে দুধ পান
করাও। অতঃপর তার জীবনের ব্যাপারে যখন শংকিত হবে, তখন তাকে নদীতে নিক্ষেপ
করবে। তুমি ভীত হয়ো না ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। আমরা ওকে তোমার কাছেই
ফিরিয়ে দেব এবং ওকে নবীদের অন্তর্ভুক্ত করব’ (ক্বাছাছ ২৮/৭)। মূলতঃ শেষের দু’টি ওয়াদাই তাঁর মাকে নিশ্চিন্ত ও উদ্বুদ্ধ করে। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَأَصْبَحَ فُؤَادُ أُمِّ مُوْسَى
فَارِغاً إِنْ كَادَتْ لَتُبْدِيْ بِهِ لَوْلاَ أَن رَّبَطْنَا عَلَى
قَلْبِهَا لِتَكُوْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ- (القصص ১০)-
‘মূসা জননীর অন্তর (কেবলি মূসার চিন্তায়) বিভোর হয়ে
পড়ল। যদি আমরা তার অন্তরকে সুদৃঢ় করে না দিতাম, তাহ’লে সে মূসার (জন্য
অস্থিরতার) বিষয়টি প্রকাশ করেই ফেলত। (আমরা তার অন্তরকে দৃঢ় করেছিলাম এ
কারণে যে) সে যেন আল্লাহর উপরে প্রত্যয়শীলদের অন্তর্ভুক্ত থাকে’ (ক্বাছাছ ২৮/১০)।
ফেরাঊনের সৈন্যদের হাতে নিহত হবার নিশ্চিত সম্ভাবনা
দেখা দিলে আল্লাহর প্রত্যাদেশ (ইলহাম) অনুযায়ী পিতা-মাতা তাদের প্রাণাধিক
প্রিয় সন্তানকে সিন্দুকে ভরে বাড়ীর পাশের নীল নদীতে ভাসিয়ে দিলেন।[17] অতঃপর স্রোতের সাথে সাথে সিন্দুকটি এগিয়ে চলল। ওদিকে মূসার (বড়) বোন তার মায়ের হুকুমে (ক্বাছাছ ২৮/১১) সিন্দুকটিকে অনুসরণ করে নদীর কিনারা দিয়ে চলতে লাগল (ত্বোয়াহা ২০/৪০)। এক সময় তা ফেরাঊনের প্রাসাদের ঘাটে এসে ভিড়ল। ফেরাঊনের পুণ্যবতী স্ত্রী আসিয়া (آسية )
বিনতে মুযাহিম ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চাটিকে দেখে অভিভূত হয়ে পড়লেন। ফেরাঊন
তাকে বনু ইস্রাঈল সন্তান ভেবে হত্যা করতে চাইল। কিন্তু সন্তানহীনা স্ত্রীর
অপত্য স্নেহের কারণে তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ফেরাঊন নিজে তার প্রতি আকৃষ্ট
হয়ে পড়েন। কারণ আল্লাহ মূসার চেহারার মধ্যে বিশেষ একটা মায়াময় কমনীয়তা দান
করেছিলেন (ত্বোয়াহা ২০/৩৯)। যাকে দেখলেই মায়া পড়ে যেত। ফেরাঊনের
হৃদয়ের পাষাণ গলতে সেটুকুই যথেষ্ট ছিল। বস্ত্ততঃ এটাও ছিল আল্লাহর মহা
পরিকল্পনারই অংশ বিশেষ। ফুটফুটে শিশুটিকে দেখে ফেরাঊনের স্ত্রী তার
স্বামীকে বললেন,
وَقَالَتِ امْرَأَتُ فِرْعَوْنَ قُرَّتُ
عَيْنٍ لِّي وَلَكَ لاَ تَقْتُلُوهُ عَسَى أَن يَّنْفَعَنَا أَوْ
نَتَّخِذَهُ وَلَداً وَهُمْ لاَ يَشْعُرُوْنَ- (القصص ৯)-
‘এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি। একে হত্যা করো না। এ
আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি’। আল্লাহ
বলেন, ‘অথচ তারা (আমার কৌশল) বুঝতে পারল না’ (ক্বাছাছ ২৮/৯)।
মূসা এক্ষণে ফেরাঊনের স্ত্রীর কোলে পুত্রস্নেহ পেতে শুরু করলেন। অতঃপর
বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য রাণীর নির্দেশে বাজারে বহু ধাত্রীর কাছে নিয়ে
যাওয়া হ’ল। কিন্তু মূসা কারুরই বুকে মুখ দিচ্ছেন না। আল্লাহ বলেন, وَحَرَّمْنَا عَلَيْهِ الْمَرَاضِعَ مِن قَبْلُ- (القصص ১২)- ‘আমরা পূর্ব থেকেই অন্যের দুধ খাওয়া থেকে মূসাকে বিরত রেখেছিলাম’ (ক্বাছাছ ২৮/১২)।
এমন সময় অপেক্ষারত মূসার ভগিনী বলল, ‘আমি কি আপনাদেরকে এমন এক পরিবারের
খবর দিব, যারা আপনাদের জন্য এ শিশু পুত্রের লালন-পালন করবে এবং তারা এর
শুভাকাংখী’? (ক্বাছাছ ২৮/১২)। রাণীর সম্মতিক্রমে মূসাকে
প্রস্তাবিত ধাত্রীগৃহে প্রেরণ করা হ’ল। মূসা খুশী মনে মায়ের দুধ গ্রহণ
করলেন। অতঃপর মায়ের কাছে রাজকীয় ভাতা ও উপঢৌকনাদি প্রেরিত হ’তে থাকল।[18]
এভাবে আল্লাহর অপার অনুগ্রহে মূসা তার মায়ের কোলে ফিরে এলেন। এভাবে
একদিকে পুত্র হত্যার ভয়ংকর আতংক হ’তে মা-বাবা মুক্তি পেলেন ও নদীতে ভাসিয়ে
দেওয়া সন্তানকে পুনরায় বুকে ফিরে পেয়ে তাদের হৃদয় শীতল হ’ল। অন্যদিকে বহু
মূল্যের রাজকীয় ভাতা পেয়ে সংসার যাত্রা নির্বাহের দুশ্চিন্তা হ’তে তারা
মুক্ত হ’লেন। সাথে সাথে সম্রাট নিয়োজিত ধাত্রী হিসাবে ও সম্রাট পরিবারের
সাথে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার ফলে তাঁদের পরিবারের সামাজিক মর্যাদাও
বৃদ্ধি পেল। এভাবেই ফেরাঊনী কৌশলের উপরে আল্লাহর কৌশল বিজয়ী হ’ল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
আল্লাহ বলেন, وَمَكَرُوا مَكْراً وَمَكَرْنَا مَكْراً وَهُمْ لاَ يَشْعُرُونَ- (النمل ৫০)- ‘তারা চক্রান্ত করেছিল এবং আমরাও কৌশল করেছিলাম। কিন্তু তারা (আমাদের কৌশল) বুঝতে পারেনি’ (নমল ২৭/৫০)।
দুগ্ধ পানের মেয়াদ শেষে মূসা অতঃপর ফেরাঊন-পুত্র
হিসাবে তার গৃহে শান-শওকতের মধ্যে বড় হ’তে থাকেন। আল্লাহর রহমতে ফেরাঊনের
স্ত্রীর অপত্য স্নেহ ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় দুনিয়াবী রক্ষাকবচ। এভাবে وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَاسْتَوَى آتَيْنَاهُ حُكْماً وَعِلْماً وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ- (القصص ১৪)- ‘যখন তিনি যৌবনে পদার্পণ করলেন এবং পূর্ণবয়ষ্ক মানুষে পরিণত হ’লেন, তখন আল্লাহ তাকে বিশেষ প্রজ্ঞা ও জ্ঞান সম্পদে ভূষিত করলেন’ (ক্বাছাছ ২৮/১৪)।
মূসা সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্যকভাবে
উপলব্ধি করলেন। দেখলেন যে, পুরা মিসরীয় সমাজ ফেরাঊনের একচ্ছত্র রাজনৈতিক
কর্তৃত্বের অধীনে কঠোরভাবে শাসিত। ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ এই সুপরিচিত ঘৃণ্য
নীতির অনুসরণে ফেরাঊন তার দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল ও একটি
দলকে দুর্বল করে দিয়েছিল (ক্বাছাছ ২৮/৪)। আর সেটি হ’ল বনু
ইস্রাঈল। প্রতিদ্বন্দ্বী জন্মাবার ভয়ে সে তাদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের
হত্যা করত ও কন্যা সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখত। এভাবে একদিকে ফেরাঊন অহংকারে
স্ফীত হয়ে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ পালনকর্তা ও সর্বাধিপতি’ ভেবে সারা দেশে অনর্থ
সৃষ্টি করছিল। এমনকি সে নিজেকে ‘একমাত্র উপাস্য’ مَاعَلمْتُ لَكُمْ مِنْ إلَهٍ غَيْرِىْ- (القصص ৩৮)- (ক্বাছাছ ২৮/৩৮)
বলতেও লজ্জাবোধ করেনি। অন্যদিকে মযলূম বনু ইস্রাঈলদের হাহাকার ও
দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। অবশেষে আল্লাহ মযলূমদের ডাকে সাড়া
দিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘দেশে যাদেরকে দুর্বল করা হয়েছিল, আমরা চাইলাম তাদের
উপরে অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতা করতে ও দেশের উত্তরাধিকারী করতে’। ‘এবং
আমরা চাইলাম তাদেরকে দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে এবং ফেরাঊন, হামান ও
তাদের সেনাবাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে, যা তারা সেই দুর্বল দলের তরফ থেকে
আশংকা করত’ (ক্বাছাছ ২৮/৫-৬)।
মূসার হৃদয় মযলূমদের প্রতি করুণায় ভারাক্রান্ত হয়ে
উঠলো। কিন্তু কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ওদিকে আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্য
রকম। মূসা একদিন দুপুরের অবসরে শহরে বেড়াতে বেরিয়েছেন। এমন সময় তাঁর সামনে
এক কান্ড ঘটে গেল। তিনি দুই ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখতে পেলেন। যাদের একজন
যালেম সম্রাটের ক্বিবতী বংশের এবং অন্যজন মযলূম বনু ইস্রাঈলের। মূসা তাদের
থামাতে গিয়ে যালেম লোকটিকে একটা ঘুষি মারলেন। কি আশ্চর্য লোকটি তাতেই
অক্কা পেল। মূসা দারুণভাবে অনুতপ্ত হলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
وَدَخَلَ الْمَدِيْنَةَ عَلَى حِيْنِ
غَفْلَةٍ مِّنْ أَهْلِهَا فَوَجَدَ فِيْهَا رَجُلَيْنِ يَقْتَتِلاَنِ
هَذَا مِنْ شِيْعَتِهِ وَهَذَا مِنْ عَدُوِّهِ فَاسْتَغَاثَهُ الَّذِيْ
مِنْ شِيْعَتِهِ عَلَى الَّذِيْ مِنْ عَدُوِّهِ فَوَكَزَهُ مُوسَى
فَقَضَى عَلَيْهِ قَالَ هَذَا مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ عَدُوٌّ
مُّضِلٌّ مُّبِيْنٌ- قَالَ رَبِّ إِنِّيْ ظَلَمْتُ نَفْسِيْ فَاغْفِرْ
لِيْ فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ- (القصص ১৫-১৬)-
‘একদিন
দুপুরে তিনি শহরে প্রবেশ করলেন, যখন অধিবাসীরা ছিল দিবানিদ্রার অবসরে। এ
সময় তিনি দু’জন ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখতে পেলেন। এদের একজন ছিল তার নিজ
গোত্রের এবং অপরজন ছিল শত্রুদলের। অতঃপর তার নিজ দলের লোকটি তার শত্রুদলের
লোকটির বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্য চাইল। তখন মূসা তাকে ঘুষি মারলেন এবং
তাতেই তার মৃত্যু হয়ে গেল। মূসা বললেন, ‘নিশ্চয়ই এটি শয়তানের কাজ। সে
মানুষকে বিভ্রান্তকারী প্রকাশ্য শত্রু’। ‘হে আমার প্রভু! আমি নিজের উপরে
যুলুম করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। অতঃপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন।
নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ক্বাছাছ ২৮/১৫-১৬)।
পরের দিন ‘জনৈক ব্যক্তি ছুটে এসে মূসাকে বলল, হে
মূসা! আমি তোমার শুভাকাংখী। তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি যে, এই মুহূর্তে তুমি
এখান থেকে বের হয়ে চলে যাও। কেননা সম্রাটের পারিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার
ষড়যন্ত্র করছে’ (ক্বাছাছ ২৮/২০)। এই লোকটি মূসার প্রতি আকৃষ্ট ও
তাঁর গুণমুগ্ধ ছিল। একথা শুনে ভীত হয়ে মূসা সেখান থেকে বের হয়ে পড়লেন
নিরুদ্দেশ যাত্রাপথে। যেমন আল্লাহ বলেন,
فَخَرَجَ مِنْهَا خَائِفاً يَّتَرَقَّبُ
قَالَ رَبِّ نَجِّنِيْ مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِيْنَ- وَلَمَّا
تَوَجَّهَ تِلْقَاءَ مَدْيَنَ قَالَ عَسَى رَبِّيْ أَنْ يَّهْدِيَنِيْ
سَوَاءَ السَّبِيْلِ- (القصص ২১-২২)-
‘অতঃপর
তিনি সেখান থেকে ভীত অবস্থায় বের হয়ে পড়লেন পথ দেখতে দেখতে এবং বললেন, হে
আমার পালনকর্তা! আমাকে যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে রক্ষা কর’। ‘এরপর যখন
তিনি (পার্শ্ববর্তী রাজ্য) মাদিয়ান অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন, তখন (দৃঢ় বিশ্বাস
নিয়ে) বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই আমার প্রভু আমাকে সরল পথ দেখাবেন’ (ক্বাছাছ ২৮/২১-২২)।
আসলে আল্লাহ চাচ্ছিলেন, ফেরাঊনের রাজপ্রাসাদ থেকে
মূসাকে বের করে নিতে এবং সাধারণ মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে পরিচিত করতে।
সাথে সাথে আল্লাহ তাঁকে তৎকালীন একজন শ্রেষ্ঠ নবীর গৃহে লালিত-পালিত করে
তাওহীদের বাস্তব শিক্ষায় আগাম পরিপক্ক করে নিতে চাইলেন।
অন্যান্য নবীদের পরীক্ষা হয়েছে সাধারণতঃ নবুঅত লাভের
পরে। কিন্তু মূসার পরীক্ষা শুরু হয়েছে তার জন্ম লাভের পর থেকেই। বস্ত্ততঃ
নবুঅত প্রাপ্তির পূর্বে ও পরে তাঁর জীবনে বহু পরীক্ষা হয়েছে। যেমন আল্লাহ
মূসা (আঃ)-কে শুনিয়ে বলেন, وَفَتَنَّاكَ فُتُوْنًا ‘আর আমরা তোমাকে অনেক পরীক্ষায় ফেলেছি’ (ত্বোয়াহা ২০/৪০)।
নবুঅত লাভের পূর্বে তাঁর প্রধান পরীক্ষা ছিল তিনটি।
যথাঃ (১) হত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া (২) মাদিয়ানে হিজরত (৩) মাদিয়ান থেকে
মিসর যাত্রা।
অতঃপর নবুঅত লাভের পর তাঁর পরীক্ষা হয় প্রধানতঃ
চারটিঃ (১) জাদুকরদের মুকাবিলা (২) ফেরাঊনের যুলুমসমূহ মুকাবিলা (৩)
সাগরডুবির পরীক্ষা (৪) বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান।
মূসার জন্ম হয়েছিল তাঁর কওমের উপরে আপতিত রাষ্ট্রীয়
হত্যাযজ্ঞের ভয়ংকর বিভীষিকার মধ্যে। আল্লাহ তাঁকে অপূর্ব কৌশলের মাধ্যমে
বাঁচিয়ে নেন। অতঃপর তাঁর জানী দুশমনের ঘরেই তাঁকে নিরাপদে ও সসম্মানে
লালন-পালন করালেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মা ও পরিবারকে করলেন উচ্চতর সামাজিক
মর্যাদায় উন্নীত। অথচ মূসার জন্মকে ঠেকানোর জন্যই ফেরাঊন তার পশুশক্তির
মাধ্যমে বনু ইস্রাঈলের শত শত শিশু পুত্রকে হত্যা করে চলছিল। এ বিষয়ে
ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।
অতঃপর যৌবনকালে তাঁর দ্বিতীয় পরীক্ষা হ’ল- হিজরতের
পরীক্ষা। মূলতঃ এটাই ছিল তাঁর জ্ঞানবুদ্ধি হবার পরে ১ম পরীক্ষা। শেষনবী সহ
অন্যান্য নবীর জীবনে সাধারণতঃ নবুঅতপ্রাপ্তির পরে হিজরতের পরীক্ষা দিতে
হয়েছে। কিন্তু মূসা (আঃ)-এর জীবনে নবুঅত প্রাপ্তির আগেই এই কঠিন পরীক্ষা
উপস্থিত হয়। অনাকাংখিত ও আকস্মিক হত্যাকান্ডের আসামী হয়ে জীবনের ভয়ে
ভীত-সন্ত্রস্ত্র মূসা ফেরাঊনের রাজ্যসীমা ছেড়ে কপর্দকহীন অবস্থায়
পার্শ্ববর্তী রাজ্য মাদিয়ানে গিয়ে উপস্থিত হ’লেন। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় কাতর
মূসা এই ভীতিকর দীর্ঘ সফরে কিভাবে চলেছেন, কি খেয়েছেন সেসব বিষয়ে
তাফসীরকারগণ বিভিন্ন চমকপ্রদ ঘটনাবলী উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কুরআন এসব
বিষয়ে চুপ থেকেছে বিধায় আমরাও চুপ থাকছি। তবে রওয়ানা হবার সময় যেহেতু মূসা
নিজেকে সম্পূর্ণরূপে স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহর উপরে সমর্পণ করেছিলেন এবং
প্রত্যাশা করেছিলেন ‘নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা আমাকে সরল পথ দেখাবেন’ (ক্বাছাছ ২৮/২২),
অতএব তাঁকে মাদিয়ানের মত অপরিচিত রাজ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া ও সসম্মানে
সেখানে বসবাস করার যাবতীয় দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে আমাদের জন্য
শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যে, সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে নিজেকে সঁপে দিলে
আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের সব দায়িত্ব নিজে নিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য যে,
বর্তমান পূর্ব জর্দানের মো‘আন (معان ) সামুদ্রিক বন্দরের অনতিদূরেই ‘মাদইয়ান’ অবস্থিত।
মাদিয়ানে প্রবেশ করে তিনি পানির আশায় একটা কূপের
দিকে গেলেন। সেখানে পানি প্রার্থী লোকদের ভিড়ের অদূরে দু’টি মেয়েকে তাদের
তৃষ্ণার্ত পশুগুলি সহ অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর হৃদয় উথলে উঠলো।
কেউ তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করছে না। মূসা নিজে মযলূম। তিনি মযলূমের ব্যথা
বুঝেন। তাই কিছুক্ষণ ইতঃস্তত করে মেয়ে দু’টির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি
তাদের সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, ‘আমরা আমাদের পশুগুলিকে পানি
পান করাতে পারি না, যতক্ষণ না রাখালরা তাদের পশুগুলিকে পানি পান করিয়ে চলে
যায়। অথচ আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ’ (যিনি ঘরে বসে আমাদের অপেক্ষায় উদগ্রীব
হয়ে আছেন)। ‘অতঃপর তাদের পশুগুলি এনে মূসা পানি পান করালেন’ (তারপর মেয়ে
দু’টি পশুগুলি নিয়ে বাড়ী চলে গেল)। মূসা একটি গাছের ছায়ায় বসে আল্লাহর
কাছে প্রার্থনা করলেন,رَبِّ إِنِّي لِمَا أَنزَلْتَ إِلَيَّ مِنْ خَيْرٍ فَقِيرٌ- (القصص ২৪)-
‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার উপর যে অনুগ্রহ নাযিল করবে, আমি তার মুখাপেক্ষী’ (ক্বাছাছ ২৮/২৪)।
হঠাৎ দেখা গেল যে ‘বালিকাদ্বয়ের একজন সলজ্জ পদক্ষেপে তাঁর দিকে আসছে’।
মেয়েটি এসে ধীর কণ্ঠে তাকে বলল, ‘আমার পিতা আপনাকে ডেকেছেন, যাতে আপনি যে
আমাদেরকে পানি পান করিয়েছেন, তার বিনিময় স্বরূপ আপনাকে পুরস্কার দিতে
পারেন’ (ক্বাছাছ ২৮/২৩-২৫)।
উল্লেখ্য যে, বালিকাদ্বয়ের পিতা ছিলেন মাদইয়ান
বাসীদের নিকটে প্রেরিত বিখ্যাত নবী হযরত শু‘আয়েব (আঃ)। মূসা ইতিপূর্বে
কখনো তাঁর নাম শোনেননি বা তাঁকে চিনতেন না। তাঁর কাছে পৌঁছে মূসা তাঁর
বৃত্তান্ত সব বর্ণনা করলেন। শু‘আয়েব (আঃ) সবকিছু শুনে বললেন, لاَتَخَفْ نَجَوْتَ مِنَ الْقَوْمِ الْظَالِمِيْنَ،
‘ভয় করো না। তুমি যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছ’। ‘এমন সময়
বালিকাদ্বয়ের একজন বলল, আববা! এঁকে বাড়ীতে কর্মচারী হিসাবে রেখে দিন।
কেননা إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِينُ আপনার কর্ম সহায়ক হিসাবে সেই-ই উত্তম হবে, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’ (ক্বাছাছ ২৮/২৬)।
‘তখন তিনি মূসাকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে
তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার বাড়ীতে কর্মচারী
থাকবে। তবে যদি দশ বছর পূর্ণ করো, সেটা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট
দিতে চাই না। আল্লাহ চাহেন তো তুমি আমাকে সদাচারী হিসাবে পাবে’। ‘মূসা বলল,
আমার ও আপনার মধ্যে এই চুক্তি স্থির হ’ল। দু’টি মেয়াদের মধ্য থেকে যেকোন
একটি পূর্ণ করলে আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না। আমরা যা বলছি, আল্লাহ
তার উপরে তত্ত্বাবধায়ক’ (ক্বাছাছ ২৮/২৫-২৮)। মূলতঃ এটাই ছিল
তাদের বিয়ের মোহরানা। সেযুগে এ ধরনের রেওয়াজ অনেকের মধ্যে চালু ছিল। যেমন
ইতিপূর্বে ইয়াকূব (আঃ) তাঁর স্ত্রীর মোহরানা বাবদ সাত বছর শ্বশুর বাড়ীতে
মেষ চরিয়েছেন। এভাবে অচেনা-অজানা দেশে এসে মূসা (আঃ) অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান
এবং অন্যান্য নিরাপত্তাসহ অত্যন্ত মর্যাদাবান ও নির্ভরযোগ্য একজন অভিভাবক
পেয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে পেলেন জীবন সাথী একজন পতি-পরায়ণা বুদ্ধিমতী স্ত্রী।
অতঃপর সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে মূসার দিনগুলি অতিবাহিত হ’তে থাকলো। সময় গড়িয়ে
এক সময় মেয়াদ পূর্ণ হ’য়ে গেল। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তিনি
চাকুরীর বাধ্যতামূলক আট বছর এবং ঐচ্ছিক দু’বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন।
কেননা এটাই নবী চরিত্রের জন্য শোভনীয় যে, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ঐচ্ছিক দু’বছরও
তিনি পূর্ণ করবেন’।[19]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
أفرسُ الناس ثلاثةٌ: صاحبُ يوسفَ حين قال
لإمرأته أكرمى مثواه عسى أن ينفعنا، وصاحبةُ موسى حين قالت يا ابت استأجره
إن خير من استأجرت القوىُّ الامين، وابوبكر الصديق حين استخلف عمرَ رضى
الله عنه-
‘সর্বাধিক দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন তিনজন: ১- ইউসুফকে
ক্রয়কারী মিসরের আযীয (রাজস্বমন্ত্রী), যখন তিনি তার স্ত্রীকে বলেছিলেন,
‘একে সম্মানের সাথে রাখ, হয়তবা সে আমাদের কল্যাণে আসবে’ ২- মূসার স্ত্রী,
যখন (বিবাহের পূর্বে) তিনি স্বীয় পিতাকে বলেছিলেন, ‘হে পিতা, এঁকে
কর্মচারী নিয়োগ করুন। নিশ্চয়ই আপনার শ্রেষ্ঠ সহযোগী তিনিই হ’তে পারেন, যিনি
শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’ এবং ৩- আবুবকর ছিদ্দীক, যখন তিনি ওমরকে তাঁর
পরবর্তী খলীফা মনোনীত করেন’।[20]
মোহরানার চুক্তির মেয়াদ শেষ। এখন যাবার পালা। পুনরায়
স্বদেশে ফেরা। দুরু দুরু বক্ষ। ভীত-সন্ত্রস্ত্র মন। চেহারায় দুশ্চিন্তার
ছাপ। তবুও যেতে হবে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন সবাই রয়েছেন মিসরে। আল্লাহর উপরে
ভরসা করে স্ত্রী-পরিবার নিয়ে বের হ’লেন পুনরায় মিসরের পথে। শুরু হ’ল তৃতীয়
পরীক্ষার পালা।
উল্লেখ্য, দশ বছরে তিনি দু’টি পুত্র সন্তান লাভ করেন
এবং শ্বশুরের কাছ থেকে পান এক পাল দুম্বা। এছাড়া তাক্বওয়া ও পরহেযগারীর
আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ তো তিনি লাভ করেছিলেন বিপুলভাবে।
পরিবারের কাফেলা নিয়ে মূসা রওয়ানা হ’লেন স্বদেশ
অভিমুখে। পথিমধ্যে মিসর সীমান্তে অবস্থিত সিনাই পর্বতমালার তূর পাহাড়ের
নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছলে হঠাৎ স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হ’ল। এখুনি
প্রয়োজন আগুনের। কিন্তু কোথায় পাবেন আগুন। পাথরে পাথরে ঘষে বৃথা চেষ্টা
করলেন কতক্ষণ। প্রচন্ড শীতে ও তুষারপাতের কারণে পাথর ঘষায় কাজ হ’ল না।
দিশেহারা হয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ অনতিদূরে আগুনের হলকা নজরে পড়ল।
আশায় বুক বাঁধলেন। স্ত্রী ও পরিবারকে বললেন, ‘তোমরা এখানে অবস্থান কর।
আমি আগুন দেখেছি। সম্ভবতঃ আমি তা থেকে তোমাদের জন্য কিছু আগুন জ্বালিয়ে
আনতে পারব অথবা সেখানে পৌঁছে পথের সন্ধান পাব’ (ত্বোয়াহা ২০/১০)। একথা দৃষ্টে মনে হয়, মূসা পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন।[21]
পথিমধ্যে শাম অঞ্চলের শাসকদের পক্ষ থেকে প্রধান সড়কে বিপদাশংকা ছিল। তাই
শ্বশুরের উপদেশ মোতাবেক তিনি পরিচিত রাস্তা ছেড়ে অপরিচিত রাস্তায় চলতে
গিয়ে মরুভূমির মধ্যে পথ হারিয়ে ডান দিকে চলে তূর পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে
পৌঁছে গেলেন। মূলতঃ এ পথ হারানোটা ছিল আল্লাহর মহা পরিকল্পনারই অংশ।
মূসা আশান্বিত হয়ে যতই আগুনের নিকটবর্তী হন, আগুনের
হল্কা ততই পিছাতে থাকে। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, সবুজ বৃক্ষের উপরে আগুন
জ্বলছে। অথচ গাছের পাতা পুড়ছে না; বরং তার উজ্জ্বলতা আরও বেড়ে যাচ্ছে।
বিস্ময়ে অভিভূত মূসা এক দৃষ্টে আগুনটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ এক
গুরুগম্ভীর আওয়ায কানে এলো তাঁর চার পাশ থেকে। মনে হ’ল পাহাড়ের সকল
প্রান্ত থেকে একই সাথে আওয়ায আসছে। মূসা তখন তূর পাহাড়ের ডান দিকে ‘তুবা’ (طُوَى) উপত্যকায় দন্ডায়মান। আল্লাহ বলেন,
فَلَمَّا أَتَاهَا نُودِيَ يَا مُوسَى-
إِنِّي أَنَا رَبُّكَ فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ إِنَّكَ بِالْوَادِ
الْمُقَدَّسِ طُوًى- (طه ১১-১২)-
‘অতঃপর যখন তিনি আগুনের কাছে পৌঁছলেন, তখন আওয়ায
এলো, হে মূসা!’ ‘আমিই তোমার পালনকর্তা। অতএব তুমি তোমার জুতা খুলে ফেল।
তুমি পবিত্র উপত্যকা তুবায় রয়েছ’ (ত্বোয়াহা ২০/১১-১২)। এর দ্বারা বিশেষ অবস্থায় পবিত্র স্থানে জুতা খোলার আদব প্রমাণিত হয়। যদিও পাক জুতা পায়ে দিয়ে ছালাত আদায় করা জায়েয।[22] অতঃপর আল্লাহ বলেন,
وَأَنَا اخْتَرْتُكَ فَاسْتَمِعْ لِمَا
يُوحَى- إِنَّنِي أَنَا اللهُ لآ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِي
وَأَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي- إِنَّ السَّاعَةَ ءاَتِيَةٌ أَكَادُ
أُخْفِيهَا لِتُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعَى- فَلاَ يَصُدَّنَّكَ
عَنْهَا مَنْ لاَ يُؤْمِنُ بِهَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَتَرْدَى- (طه ১৩-১৬)-
‘আর আমি তোমাকে মনোনীত করেছি। অতএব তোমাকে যা
প্রত্যাদেশ করা হচ্ছে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাক’। ‘নিশ্চয় আমিই আল্লাহ। আমি
ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণে ছালাত কায়েম
কর’। ‘ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তা গোপন রাখতে চাই; যাতে প্রত্যেকে তার
কর্মানুযায়ী ফল লাভ করতে পারে’। ‘সুতরাং যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতে বিশ্বাস
রাখে না এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে (ক্বিয়ামত বিষয়ে
সতর্ক থাকা হ’তে) নিবৃত্ত না করে। তাহ’লে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে’ (ত্বোয়াহা ২০/১৩-১৬)।
এ পর্যন্ত আক্বীদা ও ইবাদতগত বিষয়ে নির্দেশ দানের পর এবার কর্মগত নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলছেন,
وَمَا تِلْكَ بِيَمِينِكَ يَا مُوسَى-
قَالَ هِيَ عَصَايَ أَتَوَكَّأُ عَلَيْهَا وَأَهُشُّ بِهَا عَلَى
غَنَمِي وَلِيَ فِيهَا مَآرِبُ أُخْرَى- قَالَ أَلْقِهَا يَا مُوسَى-
فَأَلْقَاهَا فَإِذَا هِيَ حَيَّةٌ تَسْعَى- قَالَ خُذْهَا وَلاَ تَخَفْ
سَنُعِيدُهَا سِيرَتَهَا الْأُولَى- (طه ১৭-২১)-
‘হে মূসা! তোমার ডান হাতে ওটা কি?’ ‘মূসা বললেন, এটা
আমার লাঠি। এর উপরে আমি ভর দেই এবং এর দ্বারা আমার ছাগপালের জন্য গাছের
পাতা ঝেড়ে নামাই। তাছাড়া এর দ্বারা আমার অন্যান্য কাজও চলে’। ‘আল্লাহ
বললেন, হে মূসা! তুমি ওটা ফেলে দাও’। ‘অতঃপর তিনি ওটা (মাটিতে) ফেলে দিতেই
তা সাপ হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগল’। ‘আল্লাহ বললেন, তুমি ওটাকে ধর, ভয় করো
না, আমি এখুনি ওকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেব’ (ত্বোয়াহা ২০/১৭-২১)।
এটি ছিল মূসাকে দেওয়া ১ম মু‘জেযা। কেননা মিসর ছিল
ঐসময় জাদুবিদ্যায় শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী দেশ। সেখানকার শ্রেষ্ঠ জাদুকরদের
হারিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই নবুঅতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা আবশ্যক ছিল।
সেজন্যই আল্লাহ মূসাকে সবদিক দিয়ে প্রস্ত্তত করে দিচ্ছিলেন। এর ফলে মূসা
নিজের মধ্যে অনেকটা শক্তি ও স্বস্তি লাভ করলেন।
১ম মু‘জেযা প্রদানের পর আল্লাহ তাকে দ্বিতীয় মু‘জেযা প্রদানের উদ্দেশ্যে বললেন,
وَاضْمُمْ يَدَكَ إِلَى جَنَاحِكَ تَخْرُجْ بَيْضَاء مِنْ غَيْرِ سُوءٍ آيَةً أُخْرَى- لِنُرِيَكَ مِنْ آيَاتِنَا الْكُبْرَى- (طه ২২-২৩)-
‘তোমার
হাত বগলে রাখ। তারপর দেখবে তা বের হয়ে আসবে উজ্জ্বল ও নির্মল আলো হয়ে,
অন্য একটি নিদর্শন রূপে’। ‘এটা এজন্য যে, আমরা তোমাকে আমাদের বিরাট
নিদর্শনাবলীর কিছু অংশ দেখাতে চাই’ (ত্বোয়াহা ২০/২২-২৩)।
আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى تِسْعَ آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ- (إسراء 101)- ‘আমরা মূসাকে নয়টি নিদর্শন প্রদান করেছিলাম’ (ইসরা ১৭/১০১; নামল ২৭/১২)।
এখানে ‘নিদর্শন’ অর্থ একদল বিদ্বান ‘মু‘জেযা’ নিয়েছেন। তবে ৯ সংখ্যা
উল্লেখ করায় এর বেশী না হওয়াটা যরূরী নয়। বরং এর চেয়ে অনেক বেশী মু‘জেযা
তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। যেমন পাথরে লাঠি মারায় ১২টি গোত্রের জন্য বারোটি
ঝর্ণাধারা নির্গমন, তীহ্ প্রান্তরে মেঘের ছায়া প্রদান, মান্না-সালওয়া
খাদ্য অবতরণ প্রভৃতি। তবে এ নয়টি ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ নিদর্শন
সমূহের অন্তর্ভুক্ত, যা ফেরাঊনী সম্প্রদায়কে প্রদর্শন করা হয়েছিল।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) উক্ত ৯টি মু‘জেযা
নিম্নরূপে গণনা করেছেন। যথা- (১) মূসা (আঃ)-এর ব্যবহৃত লাঠি, যা নিক্ষেপ
করা মাত্র অজগর সাপের ন্যায় হয়ে যেত (২) শুভ্র হাত, যা বগলের নীচ থেকে বের
করতেই জ্যোতির্ময় হয়ে সার্চ লাইটের মত চমকাতে থাকত (৩) নিজের তোতলামি, যা
মূসার প্রার্থনাক্রমে দূর করে দেওয়া হয় (৪) ফেরাঊনী কওমের উপর প্লাবণের
গযব প্রেরণ (৫) অতঃপর পঙ্গপাল (৬) উকুন (৭) ব্যাঙ (৮) রক্ত এবং অবশেষে (৯)
নদী ভাগ করে তাকে সহ বনু ইস্রাঈলকে সাগরডুবি হ’তে নাজাত দান। তবে প্রথম
দু’টিই ছিল সর্বপ্রধান মু‘জেযা, যা নিয়ে তিনি শুরুতে ফেরাঊনের নিকটে
গিয়েছিলেন (নমল ২৭/১০, ১২)।
অবশ্য কুরআনে বর্ণিত আয়াত সমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রথমে ফেরাঊনের সম্প্রদায়ের উপরে দুর্ভিক্ষের গযব এসেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ أَخَذْنَا آلَ فِرْعَونَ بِالسِّنِينَ وَنَقْصٍ مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ- (الأعراف ১৩০)-
‘আমরা পাকড়াও করেছিলাম ফেরাঊনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে এবং
ফল-ফসলাদির ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (আ‘রাফ ৭/১৩০)।
হাফেয ইবনু কাছীর ‘তোতলামী’টা বাদ দিয়ে
‘দুর্ভিক্ষ’সহ নয়টি নিদর্শন বর্ণনা করেছেন। অবশ্য ফেরাঊন সম্প্রদায়ের উপরে
আরও একটি নিদর্শন এসেছিল ‘প্লেগ-মহামারী’ (আ‘রাফ ৭/১৩৪)। যাতে
তাদের ৭০ হাযার লোক মারা গিয়েছিল এবং পরে মূসা (আঃ)-এর দো‘আর বরকতে
মহামারী উঠে গিয়েছিল। এটাকে গণনায় ধরলে সর্বমোট নিদর্শন ১১টি হয়। তবে ‘নয়’
কথাটি ঠিক রাখতে গিয়ে কেউ তোতলামি ও প্লেগ বাদ দিয়েছেন। কেউ দুর্ভিক্ষ ও
প্লেগ বাদ দিয়েছেন। মূলতঃ সবটাই ছিল মূসা (আঃ)-এর নবুঅতের অকাট্ট দলীল ও
গুরুত্বপূর্ণ মু‘জেযা, যা মিসরে ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের উপরে প্রদর্শিত
হয়েছিল। এগুলি সবই হয়েছিল মিসরে। অতএব আমরা সেখানে পৌঁছে এসবের বিস্তারিত
বিবরণ পেশ করব ইনশাআল্লাহ।
প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীর জন্য আগুন আনতে গিয়ে মূসা
এমন এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হ’লেন, যা রীতিমত ভীতিকর, শিহরণমূলক ও
অভূতপূর্ব। তিনি স্ত্রীর জন্য আগুন নিয়ে যেতে পেরেছিলেন কি-না বা পরিবারের
সেবায় তিনি পরে কি কি ব্যবস্থা নিলেন- এসব বিষয়ে কুরআন চুপ রয়েছে। কুরআনের
গৃহীত বাকরীতি অনুযায়ী এ সবের বর্ণনা কোন যরূরী বিষয় নয়। কেননা এগুলি
সাধারণ মানবিক তাকীদ, যা যেকোন স্বামীই তার স্ত্রী ও পরিবারের জন্য করে
থাকে। অতএব এখন আমরা সামনের দিকে আগাব।
আল্লাহ পাক মূসাকে নবুঅত ও প্রধান দু’টি মু‘জেযা দানের পর নির্দেশ দিলেন,
إذْهَبْ إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى-
قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِيْ صَدْرِيْ- وَيَسِّرْ لِيْ أَمْرِي- وَاحْلُلْ
عُقْدَةً مِّن لِّسَانِيْ- يَفْقَهُوْا قَوْلِيْ- وَاجْعَلْ لِّيْ
وَزِيْراً مِّنْ أَهْلِيْ- هَارُوْنَ أَخِي- اشْدُدْ بِهِ أَزْرِيْ-
وَأَشْرِكْهُ فِيْ أَمْرِيْ- كَيْ نُسَبِّحَكَ كَثِيراً- وَّنَذْكُرَكَ
كَثِيْراً- إِنَّكَ كُنْتَ بِنَا بَصِيْراً- (طه ২৪-৩৫)-
হে মূসা! ‘তুমি ফেরাঊনের কাছে যাও। সে উদ্ধত হয়ে
গেছে’। ভীত সন্ত্রস্ত মূসা বলল, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষ উন্মোচন করে
দিন’ ‘এবং আমার কাজ সহজ করে দিন’। ‘আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দিন’
‘যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে’ ‘এবং আমার পরিবারের মধ্য থেকে একজনকে
আমার সাহায্যকারী নিযুক্ত করে দিন’। ‘আমার ভাই হারূণকে দিন’। ‘তার মাধ্যমে
আমার কোমর শক্ত করুন’ ‘এবং তাকে (নবী করে) আমার কাজে অংশীদার করুন’।
‘যাতে আমরা বেশী বেশী করে আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করতে পারি’ ‘এবং অধিক
পরিমাণে আপনাকে স্মরণ করতে পারি’। ‘আপনি তো আমাদের অবস্থা সবই দেখছেন’ (ত্বোয়াহা ২০/২৪-৩৫)।
মূসার উপরোক্ত দীর্ঘ প্রার্থনার জবাবে আল্লাহ বললেন, قَالَ قَدْ أُوتِيتَ سُؤْلَكَ يَا مُوسَى، وَلَقَدْ مَنَنَّا عَلَيْكَ مَرَّةً أُخْرَى- (طه ৩৬-৩৭)- ‘হে মূসা! তুমি যা যা চেয়েছ, সবই তোমাকে দেওয়া হ’ল’। শুধু এবার কেন, ‘আমি তোমার উপরে আরও একবার অনুগ্রহ করেছিলাম’ (ত্বোয়াহা ২০/৩৬-৩৭)। বলেই আল্লাহ মূসাকে তার জন্মের পর নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার ও ফেরাঊনের ঘরে লালন-পালনের চমকপ্রদ কাহিনী শুনিয়ে দিলেন।
আল্লাহর খেলা বুঝা ভার। হত্যার টার্গেট হয়ে জন্মলাভ
করে হত্যার ঘোষণা দানকারী সম্রাট ফেরাঊনের গৃহে পুত্রস্নেহে লালিত-পালিত
হয়ে পরে যৌবনকালে পুনরায় হত্যাকান্ডের আসামী হয়ে প্রাণভয়ে ভীত ও
কপর্দকশূন্য অবস্থায় স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমালেন। অতঃপর সেখানে দীর্ঘ
দশ বছর মেষপালকের চাকুরী করে স্ত্রী-পরিবার নিয়ে স্বদেশ ফেরার পথে
রাহযানির ভয়ে মূল রাস্তা ছেড়ে অপরিচিত রাস্তায় এসে কনকনে শীতের মধ্যে
অন্ধকার রাতে প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীকে নিয়ে মহা বিপদগ্রস্ত স্বামী যখন
অদূরে আলোর ঝলকানি দেখে আশায় বুক বেঁধে সেদিকে ছুটেছেন। তখন তিনি জানতেন
না যে, সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে এমন এক মহা সুসংবাদ যা দুনিয়ার কোন
মানুষ ইতিপূর্বে দেখেনি, শোনেনি, কল্পনাও করেনি। বিশ্ব চরাচরের পালনকর্তা
আল্লাহ স্বয়ং স্বকণ্ঠে, স্বশব্দে ও স্ব-ভাষায় তাকে ডেকে কথা বলবেন, এও কি
সম্ভব? শংকিত, শিহরিত, পুলকিত মূসা সবকিছু ভুলে পুরা দেহ-মন দিয়ে শুনছেন
স্বীয় প্রভুর দৈববাণী। দেখলেন তাঁর নূরের তাজাল্লী। চাইলেন প্রাণভরে যা
চাওয়ার ছিল। পেলেন সাথে সাথে পরিপূর্ণভাবে। এতে বুঝা যায়, পারিবারিক
সমস্যা ও রাস্তাঘাটের সমস্যা সবই আল্লাহর মেহেরবানীতে সুন্দরভাবে সমাধান
হয়ে গিয়েছিল যা কুরআনে উল্লেখের প্রয়োজন পড়েনি।
ওদিকে মূসার প্রার্থনা কবুলের সাথে সাথে আল্লাহ হারূণকে মিসরে অহীর মাধ্যমে নবুঅত প্রদান করলেন (মারিয়াম ১৯/৫৩)
এবং তাকে মূসার আগমন বার্তা জানিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে মূসাকে সার্বিক
সহযোগিতা করার এবং তাকে মিসরের বাইরে এসে অভ্যর্থনা করার নির্দেশ দেওয়া
হয়। তিনি বনু ইস্রাঈলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এগিয়ে এসে যথাযথভাবে সে নির্দেশ
পালন করেন।[23]
নবুঅতের গুরু দায়িত্ব লাভের পর মূসা (আঃ) এর গুরুত্ব
উপলব্ধি করে তা বহনের ক্ষমতা অর্জনের জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা
করেন। ইতিপূর্বে বর্ণিত দীর্ঘ প্রার্থনা সংক্ষেপে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হ’ল,
যা নিম্নরূপ:
প্রথম দো‘আ : رَبِّ اشْرَحْ لِىْ صَدْرِى
‘হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষ উন্মোচন করে দিন’। অর্থাৎ নবুঅতের বিশাল
দায়িত্ব বহনের উপযুক্ত জ্ঞান ও দূরদর্শিতার উপযোগী করে দিন এবং আমার
হৃদয়কে এমন প্রশস্ত করে দিন, যাতে উম্মতের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে প্রাপ্ত
অপবাদ ও দুঃখ-কষ্ট বহনে তা সক্ষম হয়।
দ্বিতীয় দো‘আ : وَيَسِّرْلِىْ اَمْرِىْ
‘আমার কর্ম সহজ করে দিন’। অর্থাৎ নবুঅতের কঠিন দায়িত্ব বহনের কাজ আমার
জন্য সহজ করে দিন। কেননা আল্লাহর অনুগ্রহ ব্যতীত কারু পক্ষেই কোন কাজ সহজ ও
সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। স্বীয় অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে মূসা (আঃ)
বুঝতে পেরেছিলেন যে, ফেরাঊনের মত একজন দুর্ধর্ষ, যালেম ও রক্ত পিপাসু
সম্রাটের নিকটে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করা মোটেই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়,
আল্লাহর একান্ত সাহায্য ব্যতীত।
তৃতীয় দো‘আ : وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّنْ لِّسَانِىْ يَفْقَهُوْا قَوْلِىْ
‘আমার জিহবার জড়তা দূর করে দিন, যাতে লোকেরা আমার কথা বুঝতে পারে’। কেননা
রেসালাত ও দাওয়াতের জন্য রাসূল ও দাঈকে স্পষ্টভাষী ও বিশুদ্ধভাষী হওয়া
একান্ত আবশ্যক। মূসা (আঃ) নিজের এ ত্রুটি দূর করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর
নিকটে বিশেষভাবে প্রার্থনা করেন। পরবর্তী আয়াতে যেহেতু তাঁর সকল প্রার্থনা
কবুলের কথা বলা হয়েছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৩৬), সেহেতু এ প্রার্থনাটিও যে কবুল হয়েছিল এবং তাঁর তোতলামি দূর হয়ে গিয়েছিল, সেকথা বলা যায়।
এ বিষয়ে বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে বিভিন্ন চমকপ্রদ
কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। যেমন শৈশবে তিনি মুখে আগুন পুরেছিলেন বলে তাঁর জিভ
পুড়ে গিয়েছিল। কেননা ফেরাঊনের দাড়ি ধরে চপেটাঘাত করার জন্য মূসাকে ফেরাঊন
হত্যা করতে চেয়েছিল। তাকে বাঁচানোর জন্য ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়ার উপস্থিত
বুদ্ধির জোরে তিনি বেঁচে যান। সেটি ছিল এই যে, তাকে অবোধ শিশু প্রমাণ করার
জন্য ফেরাঊনের স্ত্রী দু’টি পাত্র এনে মূসার সামনে রাখেন। মূসা তখন
জিবরাঈলের সাহায্যে মণিমুক্তার পাত্রে হাত না দিয়ে আগুনের পাত্রে হাত দিয়ে
একটা স্ফূলিঙ্গ তুলে নিজের গালে পুরে নেন। এতে তার জিভ পুড়ে যায় ও তিনি
তোৎলা হয়ে যান। ওদিকে ফেরাঊনও বুঝে নেন যে মূসা নিতান্তই অবোধ। সেকারণ
তাকে ক্ষমা করে দেন। যদিও এসব কাহিনী কুরতুবী, মাযহারী প্রভৃতি প্রসিদ্ধ
তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, তবুও এগুলোর কোন বিশুদ্ধ ভিত্তি নেই। তাই
তোৎলামির বিষয়টি স্বাভাবিক ত্রুটি ধরে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।
উল্লেখ্য যে, ইবনু আববাস (রাঃ) কর্তৃক নাসাঈতে
বর্ণিত ‘হাদীছুল ফুতূনে’ কেবল আগুনের পাত্রে হাত দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু
আগুন মুখে দেওয়ার কথা নেই। এর ফলে তিনি ফেরাঊনের হাতে নিহত হওয়া থেকে
বেঁচে যান। এ জন্য এ ঘটনাকে উক্ত হাদীছে ৩নং ফিৎনা বা পরীক্ষা হিসাবে
বর্ণনা করা হয়েছে।[24]
চতুর্থ দো‘আ : وَاجْعَلْ لِّىْ وَزِيْرًا مِّنْ أَهْلِى، هَارُوْنَ أَخِىْ
‘আমার পরিবার থেকে আমার জন্য একজন উযীর নিয়োগ করুন’। ‘আমার ভাই হারূণকে’।
পূর্বের তিনটি দো‘আ ছিল তাঁর নিজ সত্তা সম্পর্কিত। অতঃপর চতুর্থ দো‘আটি
ছিল রেসালাতের দায়িত্ব পালন সম্পর্কিত। ‘উযীর’ অর্থ বোঝা বহনকারী। মূসা
(আঃ) স্বীয় নবুঅতের বোঝা বহনে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান উপায় হিসাবে একজন
যোগ্য ও বিশ্বস্ত সহযোগী প্রার্থনা করে দায়িত্ব পালনে স্বীয় আন্তরিকতা ও
দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন এবং নির্দিষ্টভাবে নিজের বড় ভাই হারূণের নাম
করে অশেষ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ ভাই হারূণ আজন্ম মিসরেই
অবস্থান করার কারণে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল অনেক বেশী। অধিকন্তু তার উপরে
ফেরাঊনের কোন ক্রোধ বা ক্ষোভ ছিল না। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত
বিশুদ্ধভাষী ব্যক্তি, দ্বীনের দাওয়াত প্রদানের জন্য যা ছিল সবচাইতে যরূরী।
পঞ্চম দো‘আ : وَأَشْرِكْهُ فِىْ اَمْرِىْ
‘এবং তাকে আমার কাজে শরীক করে দিন’। অর্থাৎ তাকে আমার নবুঅতের কাজে শরীক
করে দিন। ‘যাতে আমরা বেশী বেশী আপনার যিকর ও পবিত্রতা বর্ণনা করতে পারি’ (ত্বোয়াহা ২০/৩৩-৩৪)।
এটা অনস্বীকার্য যে, আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে এবং আল্লাহর যিকরে
মশগুল থাকার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ যরূরী। একারণেই তিনি সৎ ও নির্ভরযোগ্য
সাথী ও সহযোগী হিসাবে বড় ভাই হারূণকে নবুঅতে শরীক করার জন্য আল্লাহর নিকটে
দো‘আ করেন। তাছাড়া তিনি একটি আশংকার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘হে আমার
পালনকর্তা, আমি তাদের এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলাম। তাই আমি ভয় করছি যে,
তারা আমাকে হত্যা করবে’। ‘আমার ভাই হারূণ, সে আমার অপেক্ষা প্রাঞ্জলভাষী।
অতএব তাকে আমার সাথে সাহায্যের জন্য প্রেরণ করুন। সে আমাকে সমর্থন যোগাবে।
আমি আশংকা করি যে, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৩-৩৪)।
উক্ত পাঁচটি দো‘আ শেষ হবার পর সেগুলি কবুল হওয়ার সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ বলেন, قَدْ أُوْتِيْتَ سُؤْلَكَ يَا مُوْسَى ‘হে মূসা! তুমি যা যা চেয়েছ, সবই তোমাকে প্রদান করা হ’ল’ (ত্বোয়াহা ২০/৩৬)। এমনকি মূসার সাহস বৃদ্ধির জন্য سَنَشُدُّ عَضُدَكَ بِأَخِيْكَ
‘আমরা তোমার ভাইয়ের মাধ্যমে তোমার বাহুকে সবল করব এবং তোমাদের দু’জনকে
আধিপত্য দান করব। ফলে শত্রুরা তোমাদের কাছেই ঘেঁষতে পারবে না। তাছাড়া আমার
নিদর্শনাবলীর জোরে তোমরা (দু’ভাই) এবং তোমাদের অনুসারীরা (শত্রুপক্ষের
উপরে) বিজয়ী থাকবে’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৫)।
তুবা প্রান্তরের উক্ত ঘটনা থেকে মূসা কেবল নবী হ’লেন
না। বরং তিনি হ’লেন ‘কালীমুল্লাহ’ বা আল্লাহর সাথে বাক্যালাপকারী। যদিও
শেষনবী (ছাঃ) মে‘রাজে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু দুনিয়াতে এভাবে
বাক্যালাপের সৌভাগ্য কেবলমাত্র হযরত মূসা (আঃ)-এর হয়েছিল। আল্লাহ বিভিন্ন
নবীকে বিভিন্ন বিষয়ে বিশিষ্টতা দান করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘হে মূসা!
আমি আমার বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে এবং আমার বাক্যালাপের মাধ্যমে তোমাকে
লোকদের উপরে বিশিষ্টতা দান করেছি। অতএব আমি তোমাকে যা কিছু দান করলাম, তা
গ্রহণ কর এবং কৃতজ্ঞ থাক’ (আ‘রাফ ৭/১৪৪)। এভাবে আল্লাহ পাক মূসা
(আঃ)-এর সাথে আরেকবার কথা বলেন, সাগর ডুবি থেকে নাজাত পাবার পরে শামে এসে
একই স্থানে ‘তওরাত’ প্রদানের সময় (আ‘রাফ ৭/১৩৮, ১৪৫)। এভাবে মূসা হ’লেন ‘কালীমুল্লাহ’।
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে সরাসরি বাক্যালাপের
পর উৎসাহিত ও পুলকিত মূসা এখানে তূর পাহাড়ের পাদদেশ এলাকায় কিছু দিন
বিশ্রাম করলেন। অতঃপর মিসর অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। সিনাই থেকে অনতিদূরে মিসর
সীমান্তে পৌঁছে গেলে যথারীতি বড় ভাই হারূণ ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এসে
তাঁদেরকে সাদর অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গের বিরুদ্ধে অলৌকিক লাঠি ও আলোকিত হস্ত তালুর দু’টি নিদর্শন নিয়ে মূসা (আঃ) মিসরে পৌঁছলেন (ক্বাছাছ ২৮/৩২)। ফেরাঊন ও তার সভাসদ বর্গকে আল্লাহ (أَئَّمِةً يَّدْعُوْنَ إِلَى النَّارِ) ‘জাহান্নামের দিকে আহবানকারী নেতৃবৃন্দ’ (ক্বাছাছ ২৮/৪১) হিসাবে এবং তাদের সম্প্রদায়কে ‘ফাসেক’ বা পাপাচারী (ক্বাছাছ ২৮/৩২)
বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ পাক মূসাকে বললেন ‘তুমি ও তোমার ভাই আমার
নিদর্শনবলীসহ যাও এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করো না’। ‘তোমরা উভয়ে ফেরাঊনের
কাছে যাও। সে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে’। ‘তোমরা তার কাছে গিয়ে নম্রভাষায় কথা
বলবে। তাতে হয়ত সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে’। ‘তারা বলল, হে আমাদের
পালনকর্তা, আমরা আশংকা করছি যে, সে আমাদের উপরে যুলুম করবে কিংবা উত্তেজিত
হয়ে উঠবে’। ‘আল্লাহ বললেন, قَالَ لاَ تَخَافَا إِنَّنِيْ مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ‘তোমরা ভয় করো না। আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি তোমাদের (সব কথা) শুনবো ও (সব অবস্থা) দেখব’ (ত্বোয়াহা ২০/৪২-৪৬)।
আল্লাহর নির্দেশমত মূসা ও হারূণ ফেরাঊন ও তার সভাসদবর্গের নিকটে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর মূসা ফেরাঊনকে বললেন,
وَقَالَ مُوسَى
يَا فِرْعَوْنُ إِنِّيْ رَسُولٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِيْنَ- حَقِيقٌ
عَلَى أَن لاَّ أَقُوْلَ عَلَى اللهِ إِلاَّ الْحَقَّ قَدْ جِئْتُكُمْ
بِبَيِّنَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ فَأَرْسِلْ مَعِيَ بَنِيْ إِسْرَائِيلَ- (الأعراف ১০৪-১০৫)-
‘হে
ফেরাঊন! আমি বিশ্বপ্রভুর পক্ষ হ’তে প্রেরিত রাসূল’। ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে
যে সত্য এসেছে, তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার ব্যাপারে আমি দৃঢ়চিত্ত। আমি
তোমাদের নিকটে তোমাদের পালনকর্তার নিদর্শন নিয়ে আগমন করেছি। অতএব তুমি বনু
ইস্রাঈলগণকে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও’ (আ‘রাফ ৭/১০৪-১০৫)। মূসার
এদাবী থেকে বুঝা যায় যে, ঐ সময় বনু ইস্রাঈলের উপরে ফেরাঊনের ও তার
সম্প্রদায়ের যুলুম চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল এবং তাদের সঙ্গে আপোষে বসবাসের
কোন রাস্তা ছিল না। ফলে তিনি তাদেরকে সেখান থেকে বের করে আনতে চাইলেন। তবে
এটা নিশ্চিত যে, মূসা তখনই বনু ইস্রাঈলকে নিয়ে বের হয়ে যাননি। এ বিষয়ে
আমরা পরে বিস্তারিত বর্ণনা করব।
মূসা ফেরাঊনকে বললেন,
وَلاَ تُعَذِّبْهُمْ قَدْ جِئْنَاكَ
بِآيَةٍ مِّنْ رَّبِّكَ وَالسَّلاَمُ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى-
إِنَّا قَدْ أُوحِيَ إِلَيْنَا أَنَّ الْعَذَابَ عَلَى مَنْ كَذَّبَ
وَتَوَلَّى- (طه ৪৭-৪৮)-
....‘তুমি বনু ইস্রাঈলদের উপরে নিপীড়ন করো না’।
‘আমরা আল্লাহর নিকট থেকে অহী লাভ করেছি যে, যে ব্যক্তি মিথ্যারোপ করে ও
মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার উপরে আল্লাহর আযাব নেমে আসে’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৭-৪৮)।
একথা শুনে ফেরাঊন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘মূসা! তোমার পালনকর্তা কে’?
‘মূসা বললেন, আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্ত্তকে তার যোগ্য
আকৃতি দান করেছেন। অতঃপর পথ প্রদর্শন করেছেন’। ‘ফেরাঊন বলল, তাহ’লে অতীত
যুগের লোকদের অবস্থা কি?’ ‘মূসা বললেন, তাদের খবর আমার প্রভুর কাছে লিখিত
আছে। আমার পালনকর্তা ভ্রান্ত হন না এবং বিস্মৃতও হন না’। একথা বলার পর
মূসা আল্লাহর নিদর্শন সমূহ বর্ণনা শুরু করলেন, যাতে ফেরাঊন তার যৌক্তিকতা
মেনে নিতে বাধ্য হয়। তিনি বললেন, আমার পালনকর্তা তিনি, ‘যিনি তোমাদের জন্য
পৃথিবীকে বিছানা স্বরূপ বানিয়েছেন এবং তাতে চলার পথ সমূহ তৈরী করেছেন।
তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ
উৎপন্ন করেন’। ‘তোমরা তা আহার কর ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুসমূহ চরিয়ে থাক।
নিশ্চয়ই এতে বিবেকবানদের জন্য নিদর্শন সমূহ রয়েছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৯-৫৪)।
১. বিশ্বের পালনকর্তা আল্লাহর দিকে আহবান।
২. আল্লাহ প্রেরিত সত্যই প্রকৃত সত্য। তার ব্যতিক্রম কিছু না বলা বা না করার ব্যাপারে সর্বদা দৃঢ়চিত্ত থাকার ঘোষণা প্রদান।
৩. আল্লাহর গযবের ভয় প্রদর্শন।
৪. আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্ব বিশ্লেষণ।
৫. পিছনের লোকদের কৃতকর্মের হিসাব আল্লাহর উপরে ন্যস্ত করে বর্তমান অবস্থার সংশোধনের প্রতি আহবান।
৬. মযলূম বনু ইস্রাঈলের মুক্তির জন্য যালেম ফেরাঊনের নিকটে আবেদন।
ফেরাঊনের অহংকারী হৃদয়ে মূসার দাওয়াত ও উপদেশবাণী কোনরূপ রেখাপাত করল না। বরং সে পরিষ্কার বলে দিল,
مَا هَذَا إِلاَّ سِحْرٌ مُّفْتَرًى
وَمَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِيْ آبَائِنَا الْأَوَّلِيْنَ- وَقَالَ
مُوسَى رَبِّيْ أَعْلَمُ بِمَنْ جَاء بِالْهُدَى مِنْ عِندِهِ وَمَنْ
تَكُوْنُ لَهُ عَاقِبَةُ الدَّارِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الظَّالِمُوْنَ- (القصص ৩৬-৩৭)-
‘তোমার এসব অলীক জাদু মাত্র। আমরা আমাদের পূর্ব
পুরুষদের মধ্যে এসব কথা শুনিনি’। ‘মূসা বললেন, ‘আমার পালনকর্তা সম্যক জানেন
কে তার নিকট থেকে হেদায়াতের কথা নিয়ে আগমন করেছে এবং কে প্রাপ্ত হবে
পরকালের গৃহ। নিশ্চয়ই যালেমরা সফলকাম হবে না’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৬-৩৭)।
ফেরাঊন তার সভাসদগণকে উদ্দেশ্য করে বলল, يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِّنْ إِلَهٍ غَيْرِيْ ‘হে পারিষদবর্গ! আমি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য আছে বলে আমি জানি না’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৮)। এরপর সে মূসার প্রতিশ্রুত ‘পরকালের গৃহ’ (عَاقِبَةُ الدَّارِ) দেখার জন্য জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তার উযীরকে বলে উঠল,
فَأَوْقِدْ لِيْ يَا هَامَانُ عَلَى
الطِّيْنِ فَاجْعَل لِّيْ صَرْحاً لَّعَلِّيْ أَطَّلِعُ إِلَى إِلَهِ
مُوسَى وَإِنِّيْ لَأَظُنُّهُ مِنَ الْكَاذِبِْينَ- وَاسْتَكْبَرَ هُوَ وَجُنُودُهُ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ إِلَيْنَا لاَ يُرْجَعُونَ- (القصص 38-39)-
‘হে হামান! তুমি ইট পোড়াও। অতঃপর আমার জন্য একটি
প্রাসাদ নির্মাণ কর, যাতে আমি মূসার উপাস্যকে উঁকি মেরে দেখতে পারি। আমার
ধারণা সে একজন মিথ্যাবাদী’। একথা বলে ‘ফেরাঊন ও তার বাহিনী অন্যায়ভাবে
অহংকারে ফেটে পড়ল। তারা ধারণা করল যে, তারা কখনোই আল্লাহর কাছে
প্রত্যাবর্তিত হবে না’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৮-৩৯; গাফির/মুমিন ২৩/৩৬-৩৭)।
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে যে, মূসা ও হারূণ যখন ফেরাঊনের
কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমরা বিশ্বজগতের পালনকর্তার রাসূল’। ‘তুমি বনু
ইস্রাঈলকে আমাদের সাথে যেতে দাও’ (শো‘আরা ২৬/১৬-১৭)। ফেরাঊন তখন
বাঁকা পথ ধরে প্রশ্ন করে বসলো, ‘আমরা কি তোমাকে শিশু অবস্থায় আমাদের
মধ্যে লালন-পালন করিনি? এবং তুমি কি আমাদের মাঝে তোমার জীবনের বহু বছর
কাটাওনি? (১৮)। ‘আর তুমি করেছিলে (হত্যাকান্ডের) সেই অপরাধ, যা
তুমি করেছিলে। (এরপরেও তুমি আমাকে পালনকর্তা না মেনে অন্যকে পালনকর্তা
বলছ?) আসলে তুমিই হ’লে কাফির বা কৃতঘ্নদের অন্তর্ভুক্ত (وَأَنتَ مِنَ الْكَافِرِيْنَ =১৯)’। জবাবে মূসা বললেন, ‘আমি সে অপরাধ তখন করেছি যখন আমি ভ্রান্ত ছিলাম’ (২০)।
‘অতঃপর আমি ভীত হয়ে তোমাদের কাছ থেকে পলায়ন করেছিলাম। এরপর আমার
পালনকর্তা আমাকে প্রজ্ঞা দান করেছেন ও আমাকে রাসূলগণের অন্তর্ভুক্ত
করেছেন’ (২১)। ‘অতঃপর আমার প্রতি তোমার যে অনুগ্রহের কথা বলছ তা এই যে, তুমি বনু ইস্রাঈলকে গোলাম বানিয়ে রেখেছ’ (২২)। ফেরাঊন একথার জবাব না দিয়ে আক্বীদাগত প্রশ্ন তুলে বলল, তোমাদের কথিত ‘বিশ্বজগতের পালনকর্তা আবার কে?’(২৩) মূসা বললেন, ‘তিনি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর পালনকর্তা, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’(২৪)। এ জবাব শুনে ‘ফেরাঊন তার পারিষদবর্গকে বলল, তোমরা কি শুনছ না’?(২৫)। ....‘আসলে তোমাদের প্রতি প্রেরিত এ রাসূলটি একটা আস্ত পাগল (الَّذِي أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ لَمَجْنُونٌ قَالَ إِنَّ رَسُولَكُمُ =২৭)। ...‘অতঃপর ফেরাঊন মূসাকে বলল, لَئِنِ اتَّخَذْتَ إِلَهاً غَيْرِي لَأَجْعَلَنَّكَ مِنَ الْمَسْجُونِينَ- (الشعراء ২৯)- ‘যদি তুমি আমার পরিবর্তে অন্যকে উপাস্যরূপে গ্রহণ কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করব’(২৯)। মূসা বললেন, ‘আমি তোমার কাছে কোন স্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে আগমন করলেও কি (তুমি আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করবে)? (শো‘আরা ২৬/১৮-৩০)।
তখন ফেরাঊন তাচ্ছিল্যভরে বলল, হে মূসা! ‘যদি তুমি কোন নিদর্শন নিয়ে এসে থাক, তাহ’লে তা উপস্থিত কর, যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাক’(৩১)। ‘মূসা তখন নিজের হাতের লাঠি মাটিতে নিক্ষেপ করলেন। ফলে তৎক্ষণাৎ তা একটা জ্বলজ্যান্ত অজগর সাপে পরিণত হয়ে গেল’(৩২)। ‘তারপর (বগল থেকে) নিজের হাত বের করলেন এবং তা সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের চোখে ধবধবে আলোকোজ্জ্বল দেখাতে লাগল’ (শো‘আরা ২৬/৩১-৩৩; আ‘রাফ ৭/১০৬-১০৮)।
ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত ‘হাদীছুল ফুতূনে’ বলা হয়েছে
যে, বিশাল ঐ অজগর সাপটি যখন বিরাট হা করে ফেরাঊনের দিকে এগিয়ে গেল, তখন
ফেরাঊন ভয়ে সিংহাসন থেকে লাফিয়ে মূসার কাছে গিয়ে আশ্রয় চাইল এবং তিনি তাকে
আশ্রয় দিলেন (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ত্বোয়াহা ২০/৪০)।
উল্লেখ্য যে, মূসার প্রদর্শিত লাঠির মো‘জেযাটি ছিল
অত্যাচারী সম্রাট ও তার যালেম সম্প্রদায়ের ভয় দেখানোর জন্য। এর দ্বারা
তাদের যাবতীয় দুনিয়াবী শক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হয়। অতঃপর প্রদীপ্ত
হস্ততালুর দ্বিতীয় মো‘জেযাটি দেখানো হয়, এটা বুঝানোর জন্যে যে, তাঁর আনীত
এলাহী বিধান মেনে চলার মধ্যেই রয়েছে অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশা। যাতে
রয়েছে মানুষের সার্বিক জীবনে শান্তি ও কল্যাণের আলোকবর্তিকা।
মু‘জেযা অর্থ মানুষের বুদ্ধিকে অক্ষমকারী। অর্থাৎ
এমন কর্ম সংঘটিত হওয়া যা মানুষের জ্ঞান ও ক্ষমতা বহির্ভূত। (১) ‘মু‘জেযা’
কেবল নবীগণের জন্য খাছ এবং ‘কারামত’ আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের মাধ্যমে
কখনো কখনো প্রকাশ করে থাকেন। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। (২)
মু‘জেযা নবীগণের মাধ্যমে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। পক্ষান্তরে জাদু
কেবল দুষ্ট জিন ও মানুষের মাধ্যমেই হয়ে থাকে এবং তা হয় অদৃশ্য প্রাকৃতিক
কারণের প্রভাবে। (৩) জাদু কেবল পৃথিবীতেই ক্রিয়াশীল হয়, আসমানে নয়। কিন্তু
মু‘জেযা আল্লাহর হুকুমে আসমান ও যমীনে সর্বত্র ক্রিয়াশীল থাকে। যেমন
শেষনবী (ছাঃ)-এর অঙ্গুলী সংকেতে আকাশের চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। (৪)
মু‘জেযা মানুষের কল্যাণের জন্য হয়ে থাকে। কিন্তু জাদু স্রেফ ভেল্কিবাজি ও
প্রতারণা মাত্র এবং যা মানুষের কেবল ক্ষতিই করে থাকে।
জাদুতে মানুষের সাময়িক বুদ্ধি বিভ্রম ঘটে। যা
মানুষকে প্রতারিত করে। এজন্যে একে ইসলামে হারাম করা হয়েছে। মিসরীয় জাতি
তথা ফেরাঊনের সম্প্রদায় ঐ সময় জাদু বিদ্যায় পারদর্শী ছিল এবং জ্যোতিষীদের
প্রভাব ছিল তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অত্যধিক। সেকারণ তাদের
চিরাচরিত ধারণা অনুযায়ী মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযাকে তারা বড় ধরনের একটা জাদু
ভেবেছিল মাত্র। তবে তারা তাঁকে সাধারণ জাদুকর নয়, বরং ‘বিজ্ঞ জাদুকর’ (سَاحِرٌ عَلِيْمٌ) বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল (আ‘রাফ ৭/১০৯)।
কারণ তাদের হিসাব অনুযায়ী মূসার জাদু ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, যা
তাদের আয়ত্তাধীন জাদু বিদ্যার বাইরের এবং যা ছিল অনুপম ও অনন্য বৈশিষ্ট্য
মন্ডিত।
পরবর্তীকালে সুলায়মান (আঃ)-এর সময়ে ইরাকের বাবেল
নগরী তৎকালীন পৃথিবীতে জাদু বিদ্যায় শীর্ষস্থান লাভ করে। তখন আল্লাহ
সুলায়মান (আঃ)-কে জিন, ইনসান, বায়ু ও পশুপক্ষীর উপর ক্ষমতা দিয়ে পাঠান।
এগুলিকে লোকেরা জাদু ভাবে এবং তার নবুঅতকে অস্বীকার করে। তখন আল্লাহ হারূত
ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়কে জাদু ও মু‘জেযার পার্থক্য বুঝানোর জন্য প্রেরণ
করেন। যাতে লোকেরা জাদুকরদের তাবেদারী ছেড়ে নবীর তাবেদার হয়।
মূসার মো‘জেযা দেখে ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গ
দারুণভাবে ভীত হয়ে পড়েছিল। তাই মূসার বিরুদ্ধে তার সম্মুখে আর টুঁ শব্দটি
পর্যন্ত করেনি। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করে তারা তাদের লোকদের
বলতে লাগল যে, ‘লোকটা বিজ্ঞ জাদুকর’। ‘সে তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিতে
চায় (অর্থাৎ সে নিজে দেশের শাসক হ’তে চায়), এক্ষণে এ ব্যাপারে তোমাদের মত
কি? ‘লোকেরা ফেরাঊনকে বলল, ‘আপনি তাকে ও তার ভাইকে অবকাশ দিন এবং শহর ও
নগরী সমূহের সর্বত্র খবর পাঠিয়ে দিন লোকদের জমা করার জন্য’। ‘যাতে তারা
সকল বিজ্ঞ জাদুকরদের সমবেত করে’ (আ‘রাফ ৭/১০৯-১১২)।
ফেরাঊন মূসা (আঃ)-কে বলল, ‘হে মূসা! তুমি কি তোমার
জাদুর জোরে আমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেবার জন্য আগমন করেছ’? ‘তাহ’লে
আমরাও তোমার মুকাবিলায় তোমার নিকট অনুরূপ জাদু উপস্থিত করব। অতএব আমাদের ও
তোমার মধ্যে কোন একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে একটা ওয়াদার দিন ধার্য কর, যার
খেলাফ আমরাও করব না, তুমিও করবে না’। ‘মূসা বললেন, ‘তোমাদের ওয়াদার দিন
হবে তোমাদের উৎসবের দিন এবং সেদিন পূর্বাহ্নেই লোকজন সমবেত হবে’ (ত্বোয়াহা ২০/৫৭-৫৯)।
১. অদৃশ্য পালনকর্তা আল্লাহ্কে অস্বীকার করে দৃশ্যমান পালনকর্তা হিসাবে নিজেকেই সর্বোচ্চ পালনকর্তা বলে দাবী করা (নাযে‘আত ৭৯/২৪)।
২. শৈশবে লালন-পালনের দোহাই পেড়ে তাকে পালনকর্তা বলে স্বীকার না করায় উল্টা মূসাকেই ‘কাফির’ বা কৃতঘ্ন বলে আখ্যায়িত করা (শো‘আরা ২৬/১৯)।
৩. পূর্ব পুরুষের কারু কাছে এমন কথা না শোনার বাহানা পেশ করা (ক্বাছাছ ২৮/৩৬)।
৪. আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার কথা অস্বীকার করা (ক্বাছাছ ২৮/৩৮)।
৫. পরকালকে অস্বীকার করা (ক্বাছাছ ২৮/৩৭)।
৬. মূসাকে কারাগারে নিক্ষেপ করার ও হত্যার হুমকি প্রদান করা (শো‘আরা ২৬/২৯; মুমিন/গাফির ৪০/২৬)।
৭. নবুঅতের মু‘জেযাকে অস্বীকার করা এবং একে জাদু বলে অভিহিত করা (ক্বাছাছ ২৮/৩৬)।
৮. মূসার নিঃস্বার্থ দাওয়াতকে রাজনৈতিক স্বার্থ প্রণোদিত বলে অপবাদ দেওয়া (আ‘রাফ ৭/১১০; ত্বোয়াহা ২০/৬৩)।
৯. নিজের কথিত ধর্ম রক্ষা ও নিজেদের রচিত বিধি-বিধান সমূহ রক্ষার দোহাই দিয়ে মূসার বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা (মুমিন/গাফির ৪০/২৬; ত্বোয়াহা ২০/৬৩)।
১০. মূসাকে দেশে ফেৎনা সৃষ্টিকারী বলে দোষারোপ করা (মুমিন/গাফির ৪০/২৬)।
বস্ত্ততঃ এই ধরনের অপবাদসমূহ যুগে যুগে প্রায় সকল নবীকে ও তাঁদের অনুসারী সমাজ সংস্কারক গণকে দেওয়া হয়েছে এবং আজও দেওয়া হচ্ছে।
মূসা (আঃ) ও ফেরাঊনের মাঝে জাদু প্রতিযোগিতার দিন ধার্য হবার পর মূসা (আঃ) পয়গম্বর সূলভ দয়া প্রকাশে নেতাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, وَيْلَكُمْ لاَ تَفْتَرُوا عَلَى اللهِ كَذِباً فَيُسْحِتَكُمْ بِعَذَابٍ وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَى- (طه ৬১)-
‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করো না। তাহ’লে তিনি
তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেবেন। যারাই মিথ্যারোপ করে, তারাই বিফল
মনোরথ হয়’ (ত্বোয়াহা ২০/৬১)। কিন্তু এতে কোন ফলোদয় হ’ল না। ফেরাঊন উঠে গিয়ে ‘তার সকল কলা-কৌশল জমা করল, অতঃপর উপস্থিত হ’ল’ (ত্বোয়াহা ২০/৬০)।
‘অতঃপর তারা তাদের কাজে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করল এবং গোপনে পরামর্শ
করল’। ‘তারা বলল, এই দু’জন লোক নিশ্চিতভাবেই জাদুকর। তারা তাদের জাদু
দ্বারা আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে চায় এবং আমাদের উৎকৃষ্ট
জীবনধারা রহিত করতে চায়’। ‘অতএব (হে জাদুকরগণ!) তোমরা তোমাদের যাবতীয়
কলা-কৌশল সংহত কর। অতঃপর সারিবদ্ধভাবে এসো। আজ যে জয়ী হবে, সেই-ই সফলকাম
হবে’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৩-৬৪)।
জাদুকররা ফেরাঊনের নিকট সমবেত হয়ে বলল, জাদুকর
ব্যক্তিটি কি দিয়ে কাজ করে? সবাই বলল, সাপ দিয়ে। তারা বলল, আল্লাহর কসম!
পৃথিবীতে আমাদের উপরে এমন কেউ নেই, যে লাঠি ও রশিকে সাপ বানিয়ে কাজ করতে
পারে (‘হাদীছুল কুতূন’ নাসাঈ, ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর)। অতএব
‘আমাদের জন্য কি বিশেষ কোন পুরস্কার আছে, যদি আমরা বিজয়ী হই’? ‘সে বলল,
হ্যাঁ। তখন অবশ্যই তোমরা আমার নিকটবর্তী লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (আ‘রাফ ৭/১১৩-১১৪)।
জাদুকররা উৎসাহিত হয়ে মূসাকে বলল, ‘হে মূসা! হয় তুমি (তোমার জাদুর লাঠি) নিক্ষেপ কর, না হয় আমরা প্রথমে নিক্ষেপ করি’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৫)। মূসা বললেন, ‘তোমরাই নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন তারা ‘তাদের রশি ও লাঠি নিক্ষেপ করল’ (শো‘আরা ২৬/৪৪), তখন লোকদের চোখগুলিকে ধাঁধিয়ে দিল এবং তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলল ও এক মহাজাদু প্রদর্শন করল’ (আ‘রাফ ৭/১১৬)।
‘তাদের জাদুর প্রভাবে মূসার মনে হ’ল যেন তাদের রশিগুলো ও লাঠিগুলো (সাপের
ন্যায়) ছুটাছুটি করছে’। ‘তাতে মূসার মনে কিছুটা ভীতির সঞ্চার হ’ল’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৬-৬৭)। এমতাবস্থায় আল্লাহ ‘অহি’ নাযিল করে মূসাকে অভয় দিয়ে বললেন, قُلْنَا
لاَ تَخَفْ إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعْلَى- وَأَلْقِ مَا فِي يَمِيْنِكَ
تَلْقَفْ مَا صَنَعُوا إِنَّمَا صَنَعُوا كَيْدُ سَاحِرٍ وَلاَ يُفْلِحُ
السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَى- (طه 68-69)- ‘তুমিই
বিজয়ী হবে’ ‘তোমার ডান হাতে যা আছে, তা (অর্থাৎ লাঠি) নিক্ষেপ কর। এটা
তাদের সবকিছুকে যা তারা করেছে, গ্রাস করে ফেলবে। তাদের ওসব তো জাদুর খেল
মাত্র। বস্ত্ততঃ জাদুকর যেখানেই থাকুক সে সফল হবে না’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৮-৬৯)।
জাদুকররা তাদের রশি ও লাঠি সমূহ নিক্ষেপ করার সময় বলল, وَقَالُوْا بِعِزَّةِ فِرْعَوْنَ إِنَّا لَنَحْنُ الْغَالِبُوْنَ- (الشعراء ৪৪)- ‘ফেরাঊনের মর্যাদার শপথ! আমরা অবশ্যই বিজয়ী হব’ (শো‘আরা ২৬/৪৪)।
তারপর মূসা (আঃ) আল্লাহর নামে লাঠি নিক্ষেপ করলেন। দেখা গেল তা বিরাট
অজগর সাপের ন্যায় রূপ ধারণ করল এবং জাদুকরদের সমস্ত অলীক কীর্তিগুলোকে
গ্রাস করতে লাগল’ (শো‘আরা ২৬/৪৫)।
এদৃশ্য দেখে যুগশ্রেষ্ঠ জাদুকরগণ বুঝে নিল যে, মূসার
এ জাদু আসলে জাদু নয়। কেননা জাদুর সর্বোচ্চ বিদ্যা তাদের কাছেই রয়েছে।
মূসা তাদের চেয়ে বড় জাদুকর হ’লে এতদিন তার নাম শোনা যেত। তার উস্তাদের খবর
জানা যেত। তাছাড়া তার যৌবনকাল অবধি সে আমাদের কাছেই ছিল। কখনোই তাকে জাদু
শিখতে বা জাদু খেলা দেখাতে বা জাদুর প্রতি কোনরূপ আকর্ষণও তার মধ্যে কখনো
দেখা যায়নি। তার পরিবারেও কোন জাদুকর নেই। তার বড় ভাই হারূণ তো সর্বদা
আমাদের মাঝেই দিনাতিপাত করেছে। কখনোই তাকে এসব করতে দেখা যায়নি বা তার
মুখে এখনকার মত বক্তব্য শোনা যায়নি। হঠাৎ করে কেউ বিশ্বসেরা জাদুকর হয়ে
যেতে পারে না। নিশ্চয়ই এর মধ্যে অলৌকিক কোন সত্তার নিদর্শন রয়েছে, যা
আয়ত্ত করা মানুষের ক্ষমতার বাইরে। এ সময় মূসার দেওয়া তাওহীদের দাওয়াত ও
আল্লাহর গযবের ভীতি তাদের অন্তরে প্রভাব বিস্তার করল। আল্লাহ বলেন, َفوَقَعَ الْحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ، فَغُلِبُواْ هُنَالِكَ وَانقَلَبُواْ صَاغِرِينَ- (الأعراف ১১৮-১১৯)- ‘অতঃপর সত্য প্রতিষ্ঠিত হ’ল এবং বাতিল হয়ে গেল তাদের সমস্ত জাদুকর্ম’। ‘এভাবে তারা সেখানেই পরাজিত হ’ল এবং লজ্জিত হয়ে ফিরে গেল’ (আ‘রাফ ৭/১১৮-১১৯)। অতঃপর فَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سَاجِدِينَ، قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ الْعَالَمِينَ، رَبِّ مُوسَى وَهَارُونَ- (الشعراء ৪৬-৪৮)- ‘তারা সিজদায় পড়ে গেল’। এবং ‘বলে উঠল, আমরা বিশ্বচরাচরের পালনকর্তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করলাম, যিনি মূসা ও হারূণের রব’ (শো‘আরা ২৬/৪৬-৪৮; ত্বোয়াহা ২০/৭০; আ‘রাফ ৭/১২০-১২১)।
পরাজয়ের এ দৃশ্য দেখে ভীত-বিহবল ফেরাঊন নিজেকে সামলে
নিয়ে উপস্থিত লাখো জনতার মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য জাদুকরদের উদ্দেশ্যে
বলে উঠলো, -آمَنتُمْ لَهُ قَبْلَ أَنْ آذَنَ لَكُمْ إِنَّهُ لَكَبِيرُكُمُ الَّذِي عَلَّمَكُمُ السِّحْرَ- (طه ৭১) ‘আমার অনুমতি দানের পূর্বেই তোমরা তাকে মেনে নিলে? নিশ্চয়ই সে (অর্থাৎ মূসা) তোমাদের প্রধান, যে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৭১; আ‘রাফ ৭/১২৩; শো‘আরা ২৬/৪৯)। অতঃপর সম্রাট সূলভ হুমকি দিয়ে বলল, فَلَسَوْفَ
تَعْلَمُونَ لَأُقَطِّعَنَّ أَيْدِيَكُمْ وَأَرْجُلَكُم مِّنْ خِلاَفٍ
وَلَأُصَلِّبَنَّكُمْ أَجْمَعِينَ- (الشعراء ৪৯)-
‘শীঘ্রই তোমরা তোমাদের পরিণাম ফল জানতে পারবে। আমি অবশ্যই তোমাদের হাত ও
পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং তোমাদের সবাইকে শূলে চড়াব’ (শো‘আরা ২৬/৪৯)। জবাবে জাদুকররা বলল, لاَ ضَيْرَ إِنَّا إِلَى رَبِّنَا مُنقَلِبُونَ- إِنَّا نَطْمَعُ أَن يَّغْفِرَ لَنَا رَبُّنَا خَطَايَانَا أَنْ كُنَّا أَوَّلَ الْمُؤْمِنِينَ- (الشعراء ৫০-৫১)- ‘কোন ক্ষতি নেই। আমরা আমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন করব’(৫০)। ‘আশা করি আমাদের পালনকর্তা আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সমূহ ক্ষমা করবেন’ (শো‘আরা ২৬/৪৯-৫১; ত্বোয়াহা ২০/৭১-৭৩; আ‘রাফ ৭/১২৪-১২৬)।
উল্লেখ্য যে, জাদুকরদের সাথে মুকাবিলার এই দিনটি (يوم الزينة) ছিল ১০ই মুহাররম আশূরার দিন (يوم عاشوراء) (ইবনু কাছীর, ‘হাদীছুল ফুতূন’)। তবে কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, এটি ছিল তাদের ঈদের দিন। কেউ বলেছেন, বাজারের দিন। কেউ বলেছেন, নববর্ষের দিন (তাফসীরে কুরতুবী, ত্বোয়াহা ৫৯)।
জাদুকরদের পরাজয়ের পর ফেরাঊন তার রাজনৈতিক কুটচালের
মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দিতে চাইল। তার চালগুলি ছিল, (১) সে
বলল: এই জাদুকররা সবাই মূসার শিষ্য। তারা চক্রান্ত করেই তার কাছে নতি
স্বীকার করেছে। এটা একটা পাতানো খেলা মাত্র। আসলে ‘মূসাই হ’ল বড় জাদুকর’ (ত্বোয়াহা ২০/৭১)। (২) সে বলল, মূসা তার জাদুর মাধ্যমে ‘নগরীর অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বের করে দিতে চায়’ (আ‘রাফ ৭/১১০)
এবং মূসা ও তার সম্প্রদায় এদেশে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। (৩) সে বলল
মূসা যেসব কথা বলছে ‘আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে সেসব কথা কখনো
শুনিনি’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৬)। (৪) সে বলল, হে জনগণ! এ লোকটি তোমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে দেবে ও দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৬)। (৫) সে বলল, মূসা তোমাদের উৎকৃষ্ট (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক) জীবন ব্যবস্থা রহিত করতে চায়’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৩)। (৬) সে মিসরীয় জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দিয়েছিল (ক্বাছাছ ২৮/৪)
এবং একটির দ্বারা অপরটিকে দুর্বল করার মাধ্যমে নিজের শাসন ও শোষণ অব্যাহত
রেখেছিল। আজকের বহুদলীয় গণতন্ত্র বা দলতন্ত্র ফেলে আসা ফেরাঊনী তন্ত্রের
আধুনিক রূপ বলেই মনে হয়। নিজেই সবকিছু করলেও লোকদের খুশী করার জন্য ফেরাঊন
বলল, فَمَاذَا تَأْمُرُونَ ‘অতএব হে জনগণ! তোমরা এখন কি বলতে চাও’? (শো‘আরা ২৬/৩৫; আ‘রাফ ৭/১১০)। এযুগের নেতারা যেমন নিজেদের সকল অপকর্ম জনগণের দোহাই দিয়ে করে থাকেন।
অধিকাংশের রায় যে সবসময় সঠিক হয় না বরং তা আল্লাহর
পথ হ’তে মানুষকে বিভ্রান্ত করে, তার বড় প্রমাণ হ’ল ফেরাঊনী কুটনীতির বিজয় ও
মূসার আপাত পরাজয়। ফেরাঊনের ভাষণে উত্তেজিত জনগণের পক্ষে নেতারা সঙ্গে
সঙ্গে বলে উঠলো, হে সম্রাট! أَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُواْ فِي الأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ- (الأعراف ১২৭)-
‘আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে এমনিই ছেড়ে দেবেন দেশময় ফাসাদ সৃষ্টি
করার জন্য এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যদেরকে বাতিল করে দেবার জন্য’ (আ‘রাফ ৭/১২৭)।
ধূর্ত ও কুটবুদ্ধি ফেরাঊন বুঝলো যে, তার ঔষধ কাজে
লেগেছে। এখুনি মোক্ষম সময়। সে সাথে সাথে জাদুকরদের হাত-পা বিপরীতভাবে কেটে
অতঃপর খেজুর গাছের সাথে শূলে চড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিল। সে ভেবেছিল, এতে
জাদুকররা ভীত হয়ে তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবে। কিন্তু ফল উল্টা হ’ল। তারা
একবাক্যে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিল,
لَن نُّؤْثِرَكَ عَلَى مَا جَاءنَا مِنَ
الْبَيِّنَاتِ وَالَّذِي فَطَرَنَا فَاقْضِ مَا أَنتَ قَاضٍ إِنَّمَا
تَقْضِي هَذِهِ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا- إِنَّا آمَنَّا بِرَبِّنَا
لِيَغْفِرَ لَنَا خَطَايَانَا وَمَا أَكْرَهْتَنَا عَلَيْهِ مِنَ
السِّحْرِ وَاللهُ خَيْرٌ وَأَبْقَى- (طه ৭২-৭৩)-
‘আমরা তোমাকে ঐসব সুস্পষ্ট নিদর্শন (ও মু‘জেযার)
উপরে প্রাধান্য দিতে পারি না, যেগুলো (মূসার মাধ্যমে) আমাদের কাছে পৌঁছেছে
এবং প্রধান্য দিতে পারি না তোমাকে সেই সত্তার উপরে যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি
করেছেন। অতএব তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার। তুমি তো কেবল এই পার্থিব জীবনেই
যা করার করবে’(৭২)। ‘আমরা আমাদের পালনকর্তার উপরে বিশ্বাস
স্থাপন করেছি, যাতে তিনি আমাদের পাপসমূহ এবং তুমি আমাদেরকে যে জাদু করতে
বাধ্য করেছ, (তার পাপসমূহ) তা মার্জনা করেন। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও
চিরস্থায়ী’ (ত্বোয়াহা ২০/৭২-৭৩)।
তারা আরও বলল,
قَالُوْا إِنَّا إِلَى رَبِّنَا
مُنقَلِبُونَ- وَمَا تَنقِمُ مِنَّا إِلاَّ أَنْ آمَنَّا بِآيَاتِ
رَبِّنَا لَمَّا جَاءتْنَا ، رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْراً
وَّتَوَفَّنَا مُسْلِمِينَ-َ- (الأعراف ১২৫-১২৬)-
‘আমরা (তো মৃত্যুর পরে) আমাদের পরওয়ারদিগারের নিকটে
ফিরে যাব’। ‘বস্ত্ততঃ আমাদের সাথে তোমার শত্রুতা তো কেবল একারণেই যে, আমরা
ঈমান এনেছি আমাদের পালনকর্তার নিদর্শন সমূহের প্রতি, যখন তা আমাদের নিকটে
পৌঁছেছে। অতএব رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَّتَوَفَّنَا مُسْلِمِينَ ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য ধৈর্যের দুয়ার খুলে দাও এবং আমাদেরকে ‘মুসলিম’ হিসাবে মৃত্যু দান কর’ (আ‘রাফ ৭/১২৫-১২৬)।
এটা ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে, ইতিপূর্বে
ফেরাঊনের দরবারে মূসার লাঠির মু‘জেযা প্রদর্শনের ঘটনা থেকেই জাদুকরদের মনে
প্রতীতি জন্মেছিল যে, এটা কোন জাদু নয়, এটা মু‘জেযা। কিন্তু ফেরাঊন ও তার
পারিষদবর্গের ভয়ে তারা মুখ খুলেনি। অবশেষে তাদেরকে সমবেত করার পর তাদেরকে
সম্রাটের নৈকট্যশীল করার ও বিরাট পুরস্কারের লোভ দেখানো হয়। এগুলো
নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রলোভনের চাপ ভিন্ন কিছুই ছিল না।
জাদুকরদের মুসলমান হয়ে যাবার অন্যতম কারণ ছিল
মুকাবিলার পূর্বে ফেরাঊন ও তার জাদুকরদের উদ্দেশ্যে মূসার প্রদত্ত
উপদেশমূলক ভাষণ। যেখানে তিনি বলেছিলেন,
وَيْلَكُمْ لَا تَفْتَرُوا عَلَى اللهِ كَذِباً فَيُسْحِتَكُمْ بِعَذَابٍ وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَ- (طه ৬১)-
‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ
করো না। তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেবেন। বস্ত্ততঃ
তারাই বিফল মনোরথ হয়, যারা মিথ্যারোপ করে’ (ত্বোয়াহা ২০/৬১)।
মূসার মুখে একথা শুনে ফেরাঊন ও তার সভাসদরা অহংকারে
স্ফীত হ’লেও জাদুকর ও সাধারণ জনগণের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। ফলে
জাদুকরদের মধ্যে গ্রুপিং হয়ে যায় এবং তারা আপোষে বিতর্কে লিপ্ত হয়। যদিও
গোপন আলোচনার ভিত্তিতে সম্ভবতঃ রাজকীয় সম্মান ও বিরাট অংকের পুরস্কারের
লোভে পরিশেষে তারা একমত হয়।
জাদুকরদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল কি-না, সে
বিষয়ে কুরআনে স্পষ্টভাবে কিছু বলা না হ’লেও ত্বোয়াহা ৭২ হ’তে ৭৬ পর্যন্ত
বর্ণিত আয়াত সমূহের বাকভঙ্গিতে বুঝা যায় যে, তা তৎক্ষণাৎ কার্যকর হয়েছিল।
কেননা নিষ্ঠুরতার প্রতীক ফেরাঊনের দর্পিত ঘোষণার জবাবে দৃঢ়চিত্ত ঈমানদার
জাদুকরদের মুখ দিয়ে যে কথাগুলো বের হয়েছিল, তা সকল ভয় ও দ্বিধা-সংকোচের
ঊর্ধ্বে উঠে কেবলমাত্র মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির মুখেই শোভা পায়। সেকারণ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, উবায়েদ ইবনু উমায়ের ও অন্যান্য বিদ্বানগণ
বলেন, أَصْبَحُوْا سَحَرَةً وَأَمْسَوْا شُهَدَاءَ ‘যারা সকালে জাদুকর ছিল, তারা সন্ধ্যায় শহীদ হয়ে মৃত্যুবরণ করল’।[25]
মূলতঃ এটাই হ’ল প্রকৃত মা‘রেফাত, যা যেকোন ভয়-ভীতির মুকাবিলায় মুমিনকে
দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় অবিচল রাখে আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্বেষায়। সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বেহামদিহী।
আল্লাহ বলেন,
فَمَا آمَنَ
لِمُوسَى إِلاَّ ذُرِّيَّةٌ مِّنْ قَوْمِهِ عَلَى خَوْفٍ مِّنْ فِرْعَوْنَ
وَمَلَئِهِمْ أَن يَّفْتِنَهُمْ وَإِنَّ فِرْعَوْنَ لَعَالٍ فِي
الأَرْضِ وَإِنَّهُ لَمِنَ الْمُسْرِفِينَ-(يونس ৮৩)-
‘ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গের নির্যাতনের ভয়ে তার
সম্প্রদায়ের কিছু লোক ব্যতীত কেউ তার প্রতি ঈমান আনেনি। আর ফেরাঊন তার দেশে
ছিল পরাক্রান্ত এবং সে ছিল সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (ইউনুস ১০/৮৩)। এতে বুঝা যায় যে, ক্বিবতীদের মধ্যে গোপনে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা বেশী থাকলেও প্রকাশ্যে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল।
উল্লেখ্য যে, অত্র আয়াতে ‘তার কওমের কিছু লোক ব্যতীত’ (إِلاَّ ذُرِّيَّةَّ مِّنْ قّوْمِهِ)
বলতে ইবনু আববাস (রাঃ) ‘ফেরাঊনের কওমের কিছু লোক’ বলেছেন। কিন্তু ইবনু
জারীর ও অনেক বিদ্বান মূসার নিজ কওম ‘বনু ইস্রাঈলের কিছু লোক’ বলেছেন। এর
জবাবে হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, এটা প্রসিদ্ধ কথা যে, বনু ইস্রাঈলের সকলেই
মূসাকে নবী হিসাবে বিশ্বাস করত একমাত্র ক্বারূণ ব্যতীত। কেননা সে ছিল
বিদ্রোহী এবং ফেরাঊনের সাথী। আর মূসার কারণেই বনু ইস্রাঈলগণ মূসার জন্মের
আগে ও পরে সমানভাবে নির্যাতিত ছিল (আ‘রাফ ৭/১২৯)। অতএব অত্র
আয়াতে যে মুষ্টিমেয় লোকের ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে, তারা নিশ্চিতভাবেই
ছিলেন ক্বিবতী সম্প্রদায়ের। আর তারা ছিলেন, ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া,
ফেরাঊনের চাচাতো ভাই জনৈক মুমিন ব্যক্তি যিনি তার ঈমান গোপন রেখেছিলেন এবং
ফেরাঊনের খাজাঞ্চি ও তার স্ত্রী। যেকথা ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন।[26]
জাদুকরদের সঙ্গে মুকাবিলা তথা সত্য ও মিথ্যার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় ফেরাঊনের নেককার স্ত্রী ও মূসার পালক মাতা (أمه البديلة)
‘আসিয়া’ উক্ত মুকাবিলার শুভ ফলাফলের জন্য সদা উদগ্রীব ছিলেন। যখন তাঁকে
মূসা ও হারূণের বিজয়ের সংবাদ শোনানো হ’ল, তখন তিনি কালবিলম্ব না করে বলে
ওঠেন, آمَنْتُ بِرَبِّ مُوْسَى وَ هَارُوْنَ
‘আমি মূসা ও হারূণের পালনকর্তার উপরে ঈমান আনলাম’। নিজ স্ত্রীর ঈমানের এ
খবর শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ফেরাঊন তাকে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতনের
মাধ্যমে হত্যা করে।[27] মৃত্যুর পূর্বে বিবি আসিয়া কাতর কণ্ঠে স্বীয় প্রভুর নিকটে প্রার্থনা করেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَضَرَبَ اللهُ مَثَلاً لِلَّذِينَ
آمَنُوا اِمْرَأَةَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِندَكَ
بَيْتاً فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي
مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ-
‘আল্লাহ ঈমানদারগণের জন্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন
ফেরাঊনের স্ত্রীর, যখন সে বলেছিল, ‘হে আমার পালনকর্তা! তোমার নিকটে
জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ কর! আমাকে ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গের
হাত থেকে উদ্ধার কর এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (তাহরীম ৬৬/১১)।
পবিত্র কুরআনের সূরা তাহরীমের ১০-১২ আয়াতে আল্লাহ
পাক চারজন নারীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে তা থেকে সকলকে উপদেশ হাছিল করতে
বলেছেন। প্রথম দু’জন দু’নবীর পত্নী। একজন নূহ (আঃ)-এর স্ত্রী, অন্যজন
লূত্ব (আঃ)-এর স্ত্রী। এ দু’জন নারী তাওহীদ বিষয়ে আপন
আপন স্বামীর তথা স্ব স্ব নবীর দাওয়াতে বিশ্বাস আনয়ন করেননি। বরং
বাপ-দাদার আমলের শিরকী আক্বীদা ও রীতি-নীতির উপরে বিশ্বাসী ছিলেন। ফলে
তারা জাহান্নামের অধিবাসী হয়েছেন। পয়গম্বরগণের সাথে বৈবাহিক সাহচর্য
তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারেনি।
বাকী দু’জন নারীর একজন বিশ্বসেরা নাস্তিক ও দাম্ভিক
সম্রাট ফেরাঊনের পুণ্যশীলা স্ত্রী ‘আসিয়া’ বিনতে মুযাহিম। তিনি মূসা
(আঃ)-এর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে স্বীয় ঈমান ঘোষণা করেন। ফেরাঊনের ঘোষিত
মৃত্যুদন্ড তিনি হাসিমুখে বরণ করে নেন। কোন কোন রেওয়ায়াত অনুসারে আল্লাহ
পাক দুনিয়াতেই তাঁকে জান্নাতের গৃহ প্রদর্শন করেছেন।[28]
চতুর্থ জন হ’লেন হযরত ঈসা (আঃ)-এর মাতা মারিয়াম বিনতে ইমরান। স্বীয় ঈমান ও
সৎকর্মের বদৌলতে তিনি আল্লাহর নিকটে মহান মর্যাদার অধিকারিণী হন। এ থেকে
বুঝানো হয়েছে যে, পুরুষ হৌক বা নারী হৌক প্রত্যেকে স্ব স্ব ঈমান ও আমলের
কারণে জান্নাতের অধিকারী হবে, অন্য কোন কারণে নয়।
মূসা (আঃ)-এর উপরে ঈমান আনয়নকারিনী আসিয়াকে শেষনবী
(ছাঃ) জগৎ শ্রেষ্ঠ চারজন মহিলার মধ্যে শামিল করেছেন। উক্ত চারজন হ’লেন
ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম, মারিয়াম বিনতে ইমরান, খাদীজা বিনতে
খুওয়াইলিদ ও ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ।[29]
জাদুর পরীক্ষায় পরাজিত ফেরাঊনের যাবতীয় আক্রোশ গিয়ে
পড়ল এবার নিরীহ বনু ইস্রাঈলগণের উপর। জাদুকরদের ঈমান আনয়ন, অতঃপর তাদের
মৃত্যুদন্ড প্রদান, বিবি আসিয়ার ঈমান আনয়ন ও তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদান
ইত্যাদি নিষ্ঠুর দমন নীতির মাধ্যমে এবং অত্যন্ত নোংরা কুটচাল ও মিথ্যা
অপবাদ সমূহের মাধ্যমে মূসার ঈমানী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চক্রান্ত
করেছিল ফেরাঊন। কিন্তু এর ফলে জনগণের মধ্যে মূসার দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে
পড়েছিল। তাতে ফেরাঊন ও তার অহংকারী পারিষদবর্গ নতুনভাবে দমন নীতির কৌশলপত্র
প্রণয়ন করল। তারা নিজেরা বিধর্মী হ’লেও সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার
জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করল। অন্যদিকে ‘বিভক্ত কর ও শাসন
কর’-এই কুটনীতির অনুসরণে ফেরাঊনের ক্বিবতী সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে কেবল বনু
ইস্রাঈলদের উপরে চূড়ান্ত যুলুম ও নির্যাতনের পরিকল্পনা করল।
ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের নেতারা ইতিপূর্বে ফেরাঊনকে বলেছিল, أَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُواْ فِي الأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ
‘আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে এমনি ছেড়ে দিবেন দেশময় ফাসাদ সৃষ্টি করার
জন্য এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যদেরকে বাতিল করে দেবার জন্য? (আ‘রাফ ৭/১২৭)।
নেতারা মূসা ও হারূণের ঈমানী দাওয়াতকে ‘ফাসাদ’ বলে অভিহিত করেছিল। এক্ষণে
দেশময় মূসার দাওয়াতের ব্যাপক প্রসার বন্ধ করার জন্য এবং ফেরাঊনের নিজ
সম্প্রদায়ের সাধারণ লোকদের ব্যাপকহারে মূসার দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার
স্রোত বন্ধ করার জন্য নিজেদের লোকদের কিছু না বলে নিরীহ বনু ইস্রাঈলদের
উপরে অত্যাচার শুরু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ফেরাঊন বলল, سَنُقَتِّلُ أَبْنَاءَهُمْ وَنَسْتَحْيِـي نِسَاءَهُمْ وَإِنَّا فَوْقَهُمْ قَاهِرُونَ- (الأعراف ১২৭)-
‘আমি এখুনি টুকরা টুকরা করে হত্যা করব ওদের পুত্র সন্তানদেরকে এবং
বাঁচিয়ে রাখব ওদের কন্যা সন্তানদেরকে। আর আমরা তো ওদের উপরে (সবদিক দিয়েই)
প্রবল’ (আ‘রাফ ৭/১২৭)। এভাবে মূসার জন্মকালে বনু ইস্রাঈলের সকল
নবজাতক পুত্র হত্যা করার সেই ফেলে আসা লোমহর্ষক নির্যাতনের পুনরাবৃত্তির
ঘোষণা প্রদান করা হ’ল।
দল ঠিক রাখার জন্য এবং সম্প্রদায়ের নেতাদের রোষাগ্নি
প্রশমনের জন্য ফেরাঊন অনুরূপ ঘোষণা দিলেও মূসা ও হারূণ সম্পর্কে তার মুখ
দিয়ে কোন কথা বের হয়নি। যদিও ইতিপূর্বে সে মূসাকে কারারুদ্ধ করার এমনকি
হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল (শো‘আরা ২৬/২৯; মুমিন ৪০/২৬)। কিন্তু
জাদুকরদের পরাজয়ের পর এবং নিজে মূসার সর্পরূপী লাঠির মু‘জেযা দেখে ভীত
বিহবল হয়ে পড়ার পর থেকে মূসার দিকে তাকানোর মত সাহসও তার ছিল না।
যাই হোক ফেরাঊনের উক্ত নিষ্ঠুর ঘোষণা জারি হওয়ার পর বনু ইস্রাঈলগণ মূসার নিকটে এসে অনুযোগের সুরে বলল, أُوْذِينَا مِنْ قَبْلِ أَن تَأْتِينَا وَمِنْ بَعْدِ مَا جِئْتَنَا ‘তোমার আগমনের পূর্বেও আমাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছে। আবার এখন তোমার আগমনের পরেও তাই করা হচ্ছে’ (আ‘রাফ ৭/১২৯)।
অর্থাৎ তোমার আগমনের পূর্বে তো এ আশায় আমাদের দিন কাটত যে, সত্বর আমাদের
উদ্ধারের জন্য একজন নবীর আগমন ঘটবে। অথচ এখন তোমার আগমনের পরেও সেই একই
নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তাহ’লে এখন আমাদের উপায় কি?
আসন্ন বিপদের আশংকায় ভীত-সন্ত্রস্ত কওমের লোকদের সান্ত্বনা দিয়ে মূসা (আঃ) বললেন, عَسَى رَبُّكُمْ أَن يُّهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الأَرْضِ فَيَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ
‘তোমাদের পালনকর্তা শীঘ্রই তোমাদের শত্রুদের ধ্বংস করে দেবেন এবং
তোমাদেরকে দেশে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন। তারপর দেখবেন, তোমরা কেমন কাজ কর’
(আ‘রাফ ৭/১২৯)। তিনি বললেন, اسْتَعِينُوا
بِاللهِ وَاصْبِرُوْا إِنَّ الأَرْضَ ِللهِ يُوْرِثُهَا مَنْ يَّشَآءُ
مِنْ عِبَادِهِ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ
‘তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর আল্লাহর নিকটে এবং ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই এ
পৃথিবী আল্লাহর। তিনি স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী
বানিয়ে দেন। বস্ত্ততঃ চূড়ান্ত পরিণাম ফল আল্লাহভীরুদের জন্যই নির্ধারিত’ (আ‘রাফ ৭/১২৮)।
মূসা (আঃ) তাদেরকে আরও বলেন,
يَا قَوْمِ إِنْ كُنتُمْ آمَنتُمْ بِاللهِ
فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوْا إِنْ كُنتُم مُّسْلِمِينَ- فَقَالُواْ عَلَى
اللهِ تَوَكَّلْنَا رَبَّنَا لاَ تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِّلْقَوْمِ
الظَّالِمِينَ- وَنَجِّنَا بِرَحْمَتِكَ مِنَ الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ-
(يونس ৮৪-৮৬)-
‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যদি আল্লাহর উপরে ঈমান
এনে থাক, তবে তাঁরই উপরে ভরসা কর যদি তোমরা আনুগত্যশীল হয়ে থাক’। জবাবে
তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করছি। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের উপরে
এ যালেম কওমের শক্তি পরীক্ষা করো না’। ‘আর আমাদেরকে অনুগ্রহ করে কাফের
সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (ইউনুস ১০/৮৪-৮৬)।
উপরোক্ত আয়াত সমূহে বুঝা যায় যে, পয়গম্বর সূলভ দরদ ও
দূরদর্শিতার আলোকে মূসা (আঃ) স্বীয় ভীত-সন্ত্রস্ত কওমকে মূলতঃ দু’টি
বিষয়ে উপদেশ দেন। এক- শত্রুর মোকাবেলায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা এবং দুই-
আল্লাহর সাহায্য না আসা পর্যন্ত সাহসের সাথে ধৈর্য ধারণ করা। সাথে সাথে
একথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, সমগ্র পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর। তিনি যাকে
খুশী এর উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেন এবং নিঃসন্দেহে শেষফল মুত্তাক্বীদের
জন্যই নির্ধারিত।
পুত্র শিশু হত্যাকান্ডের ব্যাপক যুলুমের সাথে সাথে
ফেরাঊন বনু ইস্রাঈলদের ইবাদতগৃহ সমূহ ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়। বনু
ইস্রাঈলদের ধর্মীয় বিধান ছিল এই যে, তাদের সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে
উপাসনালয়ে গিয়ে উপাসনা করতে হ’ত। এক্ষণে সেগুলি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়ায় বনু
ইস্রাঈলগণ দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ সময় মূসা ও হারূণের প্রতি আল্লাহ পাক
নিম্নোক্ত নির্দেশ পাঠান-
وَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى وَأَخِيهِ
أَنْ تَبَوَّءَا لِقَوْمِكُمَا بِمِصْرَ بُيُوتاً وَاجْعَلُوْا
بُيُوتَكُمْ قِبْلَةً وَأَقِيمُوا الصَّلاَةَ وَبَشِّرِ
الْمُؤْمِنِينَ-(يونس ৮৭)-
‘আর আমরা নির্দেশ পাঠালাম মূসা ও তার ভাইয়ের প্রতি
যে, তোমরা তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য মিসরের মাটিতে বাসস্থান নির্ধারণ কর
এবং তোমাদের ঘরগুলিকে কিবলামুখী করে তৈরী কর ও সেখানে ছালাত কায়েম কর এবং
মুমিনদের সুসংবাদ দাও’।(ইউনুস ১০/৮৭)।
বলা বাহুল্য যে, উপরোক্ত বিধান নাযিলের ফলে বনু
ইস্রাঈলগণ স্ব স্ব ঘরেই ছালাত আদায়ের সুযোগ লাভ করে। ইবনু আববাস (রাঃ)
বলেন, আল্লাহ তাদেরকে যে ক্বিবলার দিকে ফিরে ছালাত আদায় করতে নির্দেশ দেন,
সেটা ছিল কা‘বা শরীফ’ (কুরতুবী, রূহুল মা‘আনী)। বরং কোন কোন
বিদ্বান বলেছেন যে, বিগত সকল নবীর ক্বিবলা ছিল কা‘বা গৃহ। লক্ষণীয় যে,
মূসার অতুলনীয় নবুঅতী মো‘জেযা থাকা সত্ত্বেও এবং তাদেরকে সাহায্য করার
ব্যাপারে আল্লাহর স্পষ্ট ওয়াদা থাকা সত্ত্বেও ফেরাঊনী যুলুমের বিরুদ্ধে
আল্লাহ মূসাকে যুদ্ধ ঘোষণার নির্দেশ দেননি। বরং যুলুম বরদাশত করার ও ধৈর্য
ধারণের নির্দেশ দেন। ইবাদতগৃহ সমূহ ভেঙ্গে দিয়েছে বলে তা রক্ষার জন্য জীবন
দিতে বলা হয়নি। (টীকা: অতএব উপাসনালয় ধ্বংস করা ফেরাঊনী কাজ)।
বরং স্ব স্ব গৃহকে কেবলামুখী বানিয়ে সেখানেই ছালাত আদায় করতে বলা হয়েছে।
এর দ্বারা একটা মূলনীতি বেরিয়ে আসে যে, পরাক্রান্ত যালেমের বিরুদ্ধে
দুর্বল মযলূমের কর্তব্য হ’ল ধৈর্য ধারণ করা ও আল্লাহর উপরেই সবকিছু সোপর্দ
করা।
وَقَالَ مُوسَى رَبَّنَا إِنَّكَ آتَيْتَ
فِرْعَوْنَ وَمَلأَهُ زِينَةً وَأَمْوَالاً فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
رَبَّنَا لِيُضِلُّوْا عَنْ سَبِيلِكَ رَبَّنَا اطْمِسْ عَلَى
أَمْوَالِهِمْ وَاشْدُدْ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَلاَ يُؤْمِنُوْا حَتَّى
يَرَوُا الْعَذَابَ الأَلِيمَ- قَالَ قَدْ أُجِيبَتْ دَّعْوَتُكُمَا
فَاسْتَقِيمَا وَلاَ تَتَّبِعَآنِّ سَبِيلَ الَّذِينَ لاَ يَعْلَمُونَ-
(يونس ৮৮-৮৯)-
‘মূসা
বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি ফেরাঊনকে ও তার সর্দারদেরকে পার্থিব
আড়ম্বর সমূহ ও সম্পদরাজি দান করেছ, যা দিয়ে তারা লোকদেরকে তোমার রাস্তা
থেকে বিপথগামী করে। অতএব হে আমাদের প্রভু! তুমি তাদের সম্পদরাজি ধ্বংস করে
দাও ও তাদের অন্তরগুলিকে শক্ত করে দাও, যাতে তারা অতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান না
আনে, যতক্ষণ না তারা মর্মান্তিক আযাব প্রত্যক্ষ করে’(৮৮)। জবাবে আল্লাহ বললেন, তোমাদের দো‘আ কবুল হয়েছে। অতএব তোমরা দু’জন অটল থাক এবং অবশ্যই তোমরা তাদের পথে চলো না, যারা জানে না’ (ইউনুস ১০/৮৮-৮৯)।
মূসা ও হারূণের উপরোক্ত দো‘আ আল্লাহ কবুল করলেন।
কিন্তু তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে করলেন না। বরং সময় নিলেন অন্যূন
বিশ বছর। এরূপ প্রলম্বিত কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে আল্লাহ মাযলূমের ধৈর্য
পরীক্ষার সাথে সাথে যালেমেরও পরীক্ষা নিয়ে থাকেন এবং তাদের তওবা করার ও
হেদায়াত প্রাপ্তির সুযোগ দেন। যাতে পরে তাদের জন্য ওযর পেশ করার কোন সুযোগ
না থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَوْ يَشَاءُ اللهُ لاَنتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের কতককে কতকের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৪)।
প্রশ্ন হ’তে পারে, এত যুলুম সত্ত্বেও আল্লাহ তাদের
হিজরত করার নির্দেশ না দিয়ে সেখানেই পুনরায় ঘর বানিয়ে বসবাসের নির্দেশ
দিলেন কেন? এর জবাব দু’ভাবে দেওয়া যেতে পারে।
এক- ফেরাঊন তাদেরকে হিজরতে বাধা
দিত। কারণ বনু ইস্রাঈলগণকে তারা তাদের জাতীয় উন্নয়নের সহযোগী হিসাবে এবং
কর্মচারী ও সেবাদাস হিসাবে ব্যবহার করত। তাছাড়া পালিয়ে আসারও কোন পথ ছিল
না। কেননা নীলনদ ছিল বড় বাধা। নদী পার হওয়ার চেষ্টা করলে ফেরাঊনী সেনারা
তাদের পশ্চাদ্ধাবন করত।
দুই- ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের মধ্যে
মূসা ও হারূণের দাওয়াত সম্প্রসারণ করা। মূলতঃ এটিই ছিল আল্লাহর মূল
উদ্দেশ্য। কেননা যতদিন তারা মিসরে ছিলেন, সেখানকার অধিবাসীদের নিকটে
দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেছেন এবং তার ফলে বহু আল্লাহর বান্দা পথের সন্ধান
পেয়ে ধন্য হয়েছেন। ফেরাঊন দেখেছিল তার দুনিয়াবী লাভ ও শান-শওকত। কিন্তু
আল্লাহ চেয়েছিলেন তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ও মানুষের হেদায়াত। সেটিই
হয়েছে। ফেরাঊনেরা এখন মিসরের পিরামিডের দর্শনীয় বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। অথচ
মিসর সহ বলা চলে পুরা আফ্রিকায় এখন ইসলামের জয়-জয়কার অব্যাহত রয়েছে। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
(১) দুষ্টু শাসকগণ তার পদে অন্য কাউকে ভাবতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘ফেরাঊন পৃথিবীতে উদ্ধত হয়ে উঠেছিল’ (ইউনুস ১০/৮৩)। সে দাবী করেছিল, ‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ পালনকর্তা’ (নাযে‘আত ৭৯/২৪)। অতএব ‘আমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন উপাস্য আছে বলে আমি জানি না’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৮)।
যেহেতু সে তৎকালীন পৃথিবীর এক সভ্যতাগর্বী ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের একচ্ছত্র
সম্রাট ছিল, সেহেতু তার এ দাবী মিথ্যা ছিল না। এর দ্বারা সে নিজেকে
‘সৃষ্টিকর্তা’ দাবী করত না বটে, কিন্তু নিজস্ব বিধানে প্রজাপালনের কারণে
নিজেকেই সর্বোচ্চ পালনকর্তা ভেবেছিল। তার অহংকার তার চক্ষুকে নবী মূসার
অহীর বিধান মান্য করা থেকে অন্ধ করে দিয়েছিল। যুগে যুগে আবির্ভূত
স্বেচ্ছাচারী শাসকদের অবস্থা এ থেকে মোটেই পৃথক ছিল না। আজও নয়। প্রত্যেকে
নিজেকে শ্রেষ্ঠ শাসক মনে করে এবং ঐ পদে কাউকে শরীক ভাবতে পারে না।
(২) তারা তাদের বিরোধীদেরকে ধর্ম বিরোধী ও সমাজ
বিরোধী বলে। ফেরাঊন বলেছিল, তোমরা আমাকে ছাড়, মূসাকে হত্যা করতে দাও। সে
ডাকুক তার পালনকর্তাকে। আমি আশংকা করছি যে, সে তোমাদের দ্বীন এবং প্রচলিত
উৎকৃষ্ট রীতিনীতি পরিবর্তন করতে চায় এবং দেশে ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় (মুমিন ৪০/২৬, ত্বোয়াহা ২০/৬৩)। সকল যুগের ফেরাঊনরা তাদের বিরুদ্ধ বাদীদের উক্ত কথাই বলে থাকে।
(৩) তারা সর্বদা নিজেদেরকে জনগণের মঙ্গলকামী বলে।
নিজ সম্প্রদায়ের জনৈক গোপন ঈমানদার ব্যক্তি যখন মূসাকে হত্যা না করার
ব্যাপারে ফেরাঊনকে উপদেশ দিল, তখন তার জবাবে ফেরাঊন বলল, ‘আমি তোমাদেরকে
কেবল মঙ্গলের পথই দেখিয়ে থাকি’ (মুমিন ৪০/২৯)। সকল যুগের
ফেরাঊনরাও একই কথা বলে আল্লাহর বিধানকে এড়িয়ে চলে এবং নিজেদের মনগড়া বিধান
প্রতিষ্ঠায় জনগণের নামে জনগণের উপরে যুলুমের স্টীম রোলার চালিয়ে থাকে।
(৪) তাদের দেওয়া জেল-যুলুম ও হত্যার হুমকির বিপরীতে
ঈমানদারগণ সর্বদা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেন ও পরিণামে মযলূম বিজয়ী হয় ও
যালেম পর্যুদস্ত হয়। যেমন কারাদন্ড ও হত্যার হুমকি ও ফেরাঊনী যুলুমের
উত্তরে মূসার বক্তব্য ছিল: وَقَالَ مُوسَى إِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُم مِّنْ كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لاَّ يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ ‘আমি আমার ও তোমাদের পালনকর্তার আশ্রয় প্রার্থনা করছি সকল অহংকারী থেকে যে বিচার দিবসে বিশ্বাস করে না’ (মুমিন ৪০/২৭)। ফলে ‘আল্লাহ তাকে তাদের চক্রান্তের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করলেন এবং পরে ফেরাঊন গোত্রকে শোচনীয় আযাব গ্রাস করল’ (মুমিন ৪০/৪৫)। এযুগেও মযলূমের কাতর প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করে থাকেন ও যালেমকে বিভিন্নভাবে শাস্তি দিয়ে থাকেন।
ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী ফেরাঊনের জাদুকরদের সাথে
শক্তি পরীক্ষার ঘটনার পর মূসা (আঃ) অন্যূন বিশ বছর যাবত মিসরে অবস্থান করে
সেখানকার অধিবাসীদেরকে আল্লাহর বাণী শোনান এবং সত্য ও সরল পথের দিকে
দাওয়াত দিতে থাকেন। এ সময়কালের মধ্যে আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে প্রধান ৯টি
মু‘জেযা দান করেন। তবে প্লেগ মহামারী সহ (আ‘রাফ ৭/১৩৪)। মোট
নিদর্শনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টি। যার মধ্যে প্রথম দু’টি শ্রেষ্ঠ মু‘জেযা ছিল
অলৌকিক লাঠি ও আলোকময় হস্ততালু। যার পরীক্ষা শুরুতেই ফেরাঊনের দরবারে এবং
পরে জাদুকরদের সম্মুখে হয়ে গিয়েছিল। এরপর বাকীগুলি এসেছিল ফেরাঊনী কওমের
হেদায়াতের উদ্দেশ্যে তাদেরকে সাবধান করার জন্য। মূলতঃ দুনিয়াতে প্রেরিত
সকল এলাহী গযবের মূল উদ্দেশ্য থাকে মানুষের হেদায়াত। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ- (السجدة ২১)-
‘কাফির ও ফাসিকদেরকে (জাহান্নামের) কঠিন শাস্তির পূর্বে (দুনিয়াতে) আমরা
অবশ্যই লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা (আমার দিকে) ফিরে আসে’ (সাজদাহ ৩২/২১)।
মযলূম বনু ইস্রাঈলদের কাতর প্রার্থনা এবং মূসা ও
হারূণের দো‘আ আল্লাহ কবুল করেছিলেন। সেমতে সর্বপ্রথম অহংকারী ফেরাঊনী
কওমের দুনিয়াবী জৌলুস ও সম্পদরাজি ধ্বংসের গযব নেমে আসে। তারপর আসে
অন্যান্য গযব বা নিদর্শন সমূহ। আমরা সেগুলি একে একে বর্ণনা করার প্রয়াস
পাব। যাতে এযুগের মানুষ তা থেকে উপদেশ হাছিল করে।
মোট নিদর্শন সমূহ, যা মিসরে প্রদর্শিত হয়-
(১) লাঠি (২) প্রদীপ্ত হস্ততালু (৩) দুর্ভিক্ষ (৪)
তূফান (৫) পঙ্গপাল (৬) উকুন (৭) ব্যাঙ (৮) রক্ত (৯) প্লেগ (১০) সাগরডুবি।
প্রথম দু’টি এবং মূসার ব্যক্তিগত তোতলামি দূর হওয়াটা বাদ দিয়ে বাকী ৮টি
নিদর্শন নিম্নে বর্ণিত হ’ল-
মূসা (আঃ)-এর দো‘আ কবুল হওয়ার পর ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের উপরে প্রথম নিদর্শন হিসাবে দুর্ভিক্ষের গযব নেমে আসে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ أَخَذْنَا آلَ فِرْعَوْنَ بِالسِّنِيْنَ وَنَقْصٍ مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُوْنَ- (أعراف ১৩০)-
‘তারপর আমরা পাকড়াও করলাম ফেরাঊনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে এবং
ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে, যাতে তারা উপদেশ হাছিল করে’ (আ‘রাফ ৭/১৩০)।
নিরীহ বনু ইস্রাঈলগণের উপরে দুর্ধর্ষ ফেরাঊনী যুলুম
প্রতিরোধে এটা ছিল মযলূমদের সমর্থনে আল্লাহ প্রেরিত প্রথম হুঁশিয়ারী সংকেত।
এর ফলে তাদের ক্ষেতের ফসল ও বাগ-বাগিচার উৎপাদন চরমভাবে হরাস পেয়েছিল।
খাদ্যাভাবে তাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে যায়। ফলে কোন উপায়ান্তর না দেখে
ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের নেতারা মূসা (আঃ)-এর কাছে এসে কাকুতি-মিনতি করতে
থাকে। দয়ার্দ্রচিত্ত মূসা (আঃ) অবশেষে দো‘আ করলেন। ফলে দুর্ভিক্ষ রহিত হয়ে
গেল এবং তাদের বাগ-বাগিচা ও মাঠ-ময়দান পুনরায় ফল-ফসলে ভরে উঠলো। কিন্তু
ফেরাঊনী সম্প্রদায় এতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় না করে বরং অহংকারে স্ফীত হয়ে
খোদ মূসাকেই দায়ী করে তাঁকে ‘অলক্ষুণে-অপয়া’ বলে গালি দেয় এবং উদ্ধতভাবে
বলে ওঠে যে, وَقَالُوْا مَهْمَا تَأْتِنَا بِهِ مِنْ آيَةٍ لِّتَسْحَرَنَا بِهَا فَمَا نَحْنُ لَكَ بِمُؤْمِنِيْنَ- (الأعراف ১৩২)- ‘আমাদের উপরে জাদু করার জন্য তুমি যে নিদর্শনই নিয়ে আস না কেন, আমরা তোমার উপরে কোন মতেই ঈমান আনব না’ (আ‘রাফ ৭/১৩২)। আল্লাহ বলেন,
فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الطُّوْفَانَ
وَالْجَرَادَ وَالْقُمَّلَ وَالضَّفَادِعَ وَالدَّمَ آيَاتٍ
مُّفَصَّلاَتٍ فَاسْتَكْبَرُوْا وَكَانُوْا قَوْماً مُّجْرِمِيْنَ-
(الأعراف ১৩৩)-
‘অতঃপর
আমরা তাদের উপরে পাঠিয়ে দিলাম তূফান, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত প্রভৃতি
বহুবিধ নিদর্শন একের পরে এক। তারপরেও তারা অহংকার করতে থাকল। বস্ত্ততঃ
তারা ছিল পাপী সম্প্রদায়’ (আ‘রাফ ৭/১৩৩)। অত্র আয়াতে দুর্ভিক্ষের পরে পরপর পাঁচটি গযব নাযিলের কথা বলা হয়েছে। তারপর আসে প্লেগ মহামারী ও অন্যান্য ছোট-বড় আযাব’ (আ‘রাফ ৭/১৩৪)। এরপরে সর্বশেষ গযব হ’ল সাগরডুবি’ (ইউনুস ১০/৯০)। যার মাধ্যমে এই গর্বিত অহংকারীদের একেবারে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-এর তাফসীর অনুযায়ী آيَاتٌ مُفَصَّلاَتٌ
বা ‘একের পর এক আগত নিদর্শনসমূহ’ অর্থ হ’ল, এগুলোর প্রত্যেকটি আযাবই
নির্ধারিত সময় পর্যন্ত থেকে রহিত হয়ে যায় এবং কিছু দিন বিরতির পর অন্যান্য
আযাবগুলি আসে’। ফেরাঊন সম্প্রদায়ের সুবিধাবাদী চরিত্র ফুটে ওঠে নিম্নোক্ত
বর্ণনায়। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَلَمَّا وَقَعَ عَلَيْهِمُ الرِّجْزُ
قَالُواْ يَا مُوسَى ادْعُ لَنَا رَبَّكَ بِمَا عَهِدَ عِندَكَ لَئِنْ
كَشَفْتَ عَنَّا الرِّجْزَ لَنُؤْمِنَنَّ لَكَ وَلَنُرْسِلَنَّ مَعَكَ
بَنِي إِسْرَائِيلَ- فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُمُ الرِّجْزَ إِلَى
أَجَلٍ هُم بَالِغُوهُ إِذَا هُمْ يَنكُثُونَ- (الأعراف ১৩৪-১৩৫ )
‘আর যখন তাদের উপর কোন আযাব পতিত হ’ত, তখন তারা বলত,
হে মূসা! তুমি আমাদের জন্য তোমার প্রভুর নিকট দো‘আ কর, যা (কবুলের) ওয়াদা
তিনি তোমাকে দিয়েছেন। যদি তুমি আমাদের উপর থেকে এ আযাব দূর করে দাও,
তাহ’লে অবশ্যই আমরা তোমার উপর ঈমান আনব এবং তোমার সাথে বনু ইস্রাঈলদের
অবশ্যই পাঠিয়ে দেব’। ‘অতঃপর যখন আমরা তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নিতাম
নির্দিষ্ট একটা সময়ে, যে পর্যন্ত তাদের পৌঁছানো উদ্দেশ্য হ’ত, তখন তারা
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করত’ (আ‘রাফ ৭/১৩৪-৩৫)। এই নির্ধারিত সময়ের মেয়াদ কত ছিল, সে বিষয়ে বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে, যার প্রায় সবই ধারণা প্রসূত। অতএব আমরা তা থেকে বিরত রইলাম।
এ ব্যাপারে কুরআনে একটি মৌলিক বক্তব্য এসেছে এভাবে যে,
فَإِذَا جَاءتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُوْا
لَنَا هَـذِهِ وَإِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَطَّيَّرُوْا بِمُوْسَى
وَمَن مَّعَهُ أَلاَ إِنَّمَا طَائِرُهُمْ عِندَ اللهِ وَلَـكِنَّ
أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُوْنَ- (الأعراف ১৩১)-
‘যখন তাদের শুভদিন ফিরে আসত, তখন তারা বলত যে, এটাই
আমাদের জন্য উপযুক্ত। পক্ষান্তরে অকল্যাণ উপস্থিত হ’লে তারা মূসা ও তার
সাথীদের ‘অলক্ষুণে’ বলে অভিহিত করত। জেনে রাখ যে, তাদের অলক্ষুণে চরিত্র
আল্লাহর ইলমে রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ তা জানে না’ (আ‘রাফ ৭/১৩১)।
এতে বুঝা যায় যে, একটা গযব শেষ হওয়ার পর শুভদিন আসতে এবং পিছনের ভয়াবহ
দুর্দশার কথা ভুলতে ও পুনরায় গর্বে স্ফীত হ’তে নিশ্চয়ই বেশ দীর্ঘ সময়ের
প্রয়োজন হ’ত। আমরা পূর্বেই ঐতিহাসিক বর্ণনায় জেনেছি যে, জাদুকরদের সাথে
পরীক্ষার পর মূসা (আঃ) বিশ বছরের মত মিসরে ছিলেন। তারপরে সাগর ডুবির গযব
নাযিল হয়। অতএব জাদুকরদের সাথে মুকাবিলার পর হ’তে সাগর ডুবি পর্যন্ত এই
দীর্ঘ সময়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও প্লেগ সহ আয়াতে বর্ণিত আটটি গযব নাযিল
হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনার উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনুল
মুনযির যে বলেছেন যে, প্রতিটি আযাব শনিবারে এসে পরের শনিবারে চলে যেত এবং
পরবর্তী আযাব আসা পর্যন্ত তিন সপ্তাহের অবকাশ দেওয়া হ’ত কথাটি তাই মেনে
নেওয়া মুশকিল বৈ-কি।
দুর্ভিক্ষের পরে মূসা (আঃ)-এর দো‘আর বরকতে পুনরায়
ভরা মাঠ ও ভরা ফসল পেয়ে ফেরাঊনী সম্প্রদায় পিছনের সব কথা ভুলে যায় ও গর্বে
স্ফীত হয়ে মূসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটাতে থাকে। তারা সাধারণ লোকদের
ঈমান গ্রহণে বাধা দিতে থাকে। তারা তাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে পুনরায়
ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে থাকে। ফলে তাদের উপরে গযব আকারে প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাস
নেমে আসে। যা তাদের মাঠ-ঘাট, বাগান-ফসল, ঘর-বাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এতে
ভীত হয়ে তারা আবার মূসা (আঃ)-এর কাছে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আবার
তারা ঈমান আনার প্রতিজ্ঞা করে ও আল্লাহর নিকটে দো‘আ করার জন্য মূসা
(আঃ)-কে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। ফলে মূসা (আঃ) দো‘আ করেন ও আল্লাহর রহমতে
তূফান চলে যায়। পুনরায় তারা জমি-জমা আবাদ করে ও অচিরেই তা সবুজ-শ্যামল হয়ে
ওঠে। এ দৃশ্য দেখে তারা আবার অহংকারী হয়ে ওঠে এবং বলতে থাকে, আসলে আমাদের
জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্যেই প্লাবন এসেছিল, আর সেকারণেই আমাদের
ফসল এবার সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে ও বাম্পার ফলন হয়েছে। আসলে আমাদের
কর্ম দক্ষতার ফল হিসাবে এটাই উপযুক্ত। এভাবে তারা অহংকারে মত্ত হয়ে আবার
শুরু করল বনী ইস্রাঈলদের উপরে যুলুম-অত্যাচার। ফলে নেমে এল তৃতীয় গযব।
একদিন হঠাৎ হাযার হাযার পঙ্গপাল কোত্থেকে ঝাঁকে
ঝাঁকে এসে ফেরাঊনীদের সব ফসল খেয়ে ছাফ করে গেল। তারা তাদের বাগ-বাগিচার
ফল-ফলাদি খেয়ে সাবাড় করে ফেলল। এমনকি কাঠের দরজা-জানালা, আসবাব-পত্র
পর্যন্ত খেয়ে শেষ করল। অথচ পাশাপাশি বনু ইস্রাঈলদের ঘরবাড়ি, শস্যভূমি ও
বাগ-বাগিচা সবই সুরক্ষিত থাকে।
এবারও ফেরাঊনী সম্প্রদায় ছুটে এসে মূসা (আঃ)-এর কাছে
কাতর কণ্ঠে নিবেদন করতে থাকে, যাতে গযব চলে যায়। তারা এবার পাকা ওয়াদা করল
যে, তারা ঈমান আনবে ও বনু ইস্রাঈলদের মুক্তি দেবে। মূসা (আঃ) দো‘আ করলেন ও
আযাব চলে গেল। পরে ফেরাঊনীরা দেখল যে, পঙ্গপালে খেয়ে গেলেও এখনও যা
অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে বেশ কিছুদিন চলে যাবে। ফলে তারা আবার শয়তানী ধোঁকায়
পড়ে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল ও পূর্বের ন্যায় ঔদ্ধত্য প্রদর্শন শুরু করল। ফলে
নেমে এল পরবর্তী গযব ‘উকুন’।
‘উকুন’ সাধারণতঃ মানুষের মাথার চুলে জন্মে থাকে। তবে
এখানে ব্যাপক অর্থে ঘুণ পোকা ও কেড়ি পোকাকেও গণ্য করা হয়েছে। যা
ফেরাঊনীদের সকল প্রকার কাঠের খুঁটি, দরজা-জানালা, খাট-পালংক ও আসবাব-পত্রে
এবং খাদ্য-শস্যে লেগেছিল। তাছাড়া দেহের সর্বত্র সর্বদা উকুনের কামড়ে তারা
অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। এভাবে উকুন ও ঘুণপোকার অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে এক সময়
তারা কাঁদতে কাঁদতে মূসা (আঃ)-এর দরবারে এসে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো
এবং প্রতিজ্ঞার পরে প্রতিজ্ঞা করে বলতে লাগলো যে, এবারে আযাব ফিরে গেলে
তারা অবশ্যই ঈমান আনবে, তাতে বিন্দুমাত্র অন্যথা হবে না। মূসা (আঃ) তাদের
জন্য দো‘আ করলেন এবং আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা কিছু দিনের মধ্যেই
প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল এবং পূর্বের ন্যায় অবাধ্য আচরণ শুরু করল। আল্লাহর পক্ষ
থেকে বারবার অবকাশ দেওয়াকে তারা তাদের ভালত্বের পক্ষে দলীল হিসাবে মনে
করতে লাগল এবং হেদায়াত দূরে থাক, তাদের অহংকার ক্রমে বাড়তে লাগল। মূলতঃ
এগুলো ছিল তাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের অবস্থা। নইলে সাধারণ মানুষ মূসা ও
হারূণের দাওয়াত অন্তরে কবুল করে যাচ্ছিল এবং তাদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি
পাচ্ছিল। আর এতেই ছিল মূসা (আঃ)-এর সান্ত্বনা। আল্লাহ বলেন, وَإِذَا
أَرَدْنَا أَن نُّهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوْا
فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا-
(الإسراء ১৬)-
‘যখন আমরা কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন সেখানকার নেতৃস্থানীয়
ব্যক্তিদেরকে উদ্বুদ্ধ করি। অতঃপর তারা পাপাচারে লিপ্ত হয়। ফলে উক্ত
জনগোষ্ঠীর উপরে আদেশ অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমরা উক্ত জনপদকে সমূলে
বিধ্বস্ত করি’ (ইসরা ১৭/১৬)। ফেরাঊনীদের উপরে সেই অবস্থা এসে
গিয়েছিল। তাদের নেতারা স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা
তাদের লোকদের বুঝাতে লাগলো যে, এসবই মূসার জাদুর খেল। আসলে আল্লাহ বলে
কিছুই নেই। ফলে নেমে এল এবার ‘ব্যাঙ’-এর গযব।
বারবার বিদ্রোহ করা সত্ত্বেও দয়ালু আল্লাহ তাদের
সাবধান করার জন্য ও আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য পুনরায় গযব পাঠালেন। এবার
এল ব্যাঙ। ব্যাঙে ব্যাঙে ভরে গেল তাদের ঘর-বাড়ি, হাড়ি-পাতিল, জামা-কাপড়,
বিছানা-পত্তর সবকিছু। বসতে ব্যাঙ, খেতে ব্যাঙ, চলতে ব্যাঙ, গায়ে-মাথায়
সর্বত্র ব্যাঙের লাফালাফি। কোন জায়গায় বসা মাত্র শত শত ব্যাঙের নীচে তলিয়ে
যেতে হ’ত। এই নরম জীবটির সরস অত্যাচারে পাগলপরা হয়ে উঠল পুরা ফেরাঊনী
জনপদ। অবশেষে কান্নাকাটি করে ও কাকুতি-মিনতি করে তারা এসে ক্ষমা প্রার্থনা
করতে লাগলো মূসা (আঃ)-এর কাছে। এবার পাকাপাকি ওয়াদা করল যে, আযাব চলে
যাবার সাথে সাথে তারা ঈমান আনবেই। কিন্তু না, যথা পূর্বং তথা পরং। ফলে
পুনরায় গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। এবারে এল ‘রক্ত’।
তাদের অহংকার ও ঔদ্ধত্য চরমে উঠলে হঠাৎ একদিন দেখা
গেল ‘রক্ত’। খাদ্য ও পানপাত্রে রক্ত, কূয়া ও পুকুরে রক্ত, তরি-তরকারিতে
রক্ত, কলসি-বালতিতে রক্ত। একই সাথে খেতে বসে বনু ইস্রাঈলের থালা-বাটি
স্বাভাবিক। কিন্তু ফেরাঊনী ক্বিবতীর থালা-বাটি রক্তে ভরা। পানি মুখে নেওয়া
মাত্র গ্লাসভর্তি রক্ত। অহংকারী নেতারা বাধ্য হয়ে বনু ইস্রাঈলী মযলূমদের
বাড়ীতে এসে খাদ্য ও পানি ভিক্ষা চাইত। কিন্তু যেমনি তাদের হাতে তা পৌঁছত,
অমনি সেগুলো রক্তে পরিবর্তিত হয়ে যেত। ফলে তাদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে
গেল। না খেয়ে তাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেল। অবশেষে পূর্বের ন্যায় আবার এসে
কান্নাকাটি। মূসা (আঃ) দয়া পরবশে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন। ফলে
আযাব চলে গেল। কিন্তু ঐ নেতাগুলো পূর্বের মতই তাদের গোমরাহীতে অনড় রইল এবং
ঈমান আনলো না। এদের এই হঠকারিতা ও কপট আচরণের কথা আল্লাহ বর্ণনা করেন
এভাবে, فَاسْتَكْبَرُوْا وَكَانُوْا قَوْمًا مُّجْرِمِيْنَ-(الأعراف ১৩৩)- ‘অতঃপর তারা আত্মম্ভরিতা দেখাতে লাগলো। বস্ত্ততঃ এরা ছিল পাপাসক্ত জাতি’ (আ‘রাফ ৭/১৩৩)। ফলে নেমে এল এবার প্লেগ মহামারী।
রক্তের আযাব উঠিয়ে নেবার পরও যখন ওরা ঈমান আনলো না, তখন আল্লাহ ওদের উপরে প্লেগ মহামারী প্রেরণ করেন (আ‘রাফ ৭/১৩৪)।
অনেকে এটাকে ‘বসন্ত’ রোগ বলেছেন। যাতে অল্প দিনেই তাদের সত্তর হাযার লোক
মারা যায়। অথচ বনু ইস্রাঈলরা ভাল থাকে। এলাহী গযবের সাথে সাথে এগুলি ছিল
মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযা এবং নবুঅতের নিদর্শন। কিন্তু জাহিল ও আত্মগর্বী
নেতারা একে ‘জাদু’ বলে তাচ্ছিল্য করত।
প্লেগের মহামারীর ফলে ব্যাপক প্রাণহানিতে ভীত হয়ে
তারা আবার এসে মূসা (আঃ)-এর নিকটে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে লাগল। মূসা
(আঃ) আবারও তাদের জন্য দো‘আ করলেন। ফলে আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা পূর্বের
ন্যায় আবারো ওয়াদা ভঙ্গ করল। ফলে তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অবধারিত হয়ে গেল।
আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ حَقَّتْ عَلَيْهِمْ
كَلِمَتُ رَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ-وَلَوْ جَاءتْهُمْ كُلُّ آيَةٍ حَتَّى
يَرَوُا الْعَذَابَ الأَلِيْمَ- (يونس ৯৬-৯৭)-
‘নিশ্চয়ই যাদের উপরে তোমার প্রভুর আদেশ নির্ধারিত হয়ে গেছে, তারা কখনো
বিশ্বাস আনয়ন করে না, যদিও সব রকমের নিদর্শনাবলী তাদের নিকটে পৌছে যায়,
এমনকি তারা মর্মান্তিক আযাব প্রত্যক্ষ করে’ (ইউনুস ১০/৯৬-৯৭)।
ক্রমাগত পরীক্ষা ও অবকাশ দানের পরও যখন কোন জাতি
সম্বিত ফিরে পায় না। বরং উল্টা তাদের অহংকার বাড়তে বাড়তে তুঙ্গে ওঠে, তখন
তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। আল্লাহ পাক বলেন,
وَلَقَدْ أَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى أَنْ
أَسْرِ بِعِبَادِي فَاضْرِبْ لَهُمْ طَرِيقاً فِي الْبَحْرِ يَبَساً لاَّ
تَخَافُ دَرَكاً وَّلاَ تَخْشَى- (طه ৭৭)-
‘আমরা মূসার প্রতি এই মর্মে অহী করলাম যে, আমার
বান্দাদের নিয়ে রাত্রিযোগে বের হয়ে যাও এবং তাদের জন্য সমুদ্রে শুষ্কপথ
নির্ধারণ কর। পিছন থেকে এসে তোমাদের ধরে ফেলার আশংকা কর না এবং (পানিতে
ডুবে যাওয়ার) ভয় কর না’ (ত্বোয়াহা ২০/৭৭)।
আল্লাহর হুকুম পেয়ে মূসা (আঃ) রাত্রির সূচনা লগ্নে
বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে রওয়ানা হ’লেন। তাঁরা সমুদ্রের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
এ সমুদ্র কোনটা ছিল এ ব্যাপারে মুফতী মুহাম্মাদ শফী তাফসীর রূহুল মা‘আনীর
বরাত দিয়ে ৮৬০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, ওটা ছিল ‘ভূমধ্যসাগর’।[30]
একই তাফসীরে ৪৭৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘লোহিত সাগর’। কিন্তু মাওলানা মওদূদী
খ্যাতনামা পাশ্চাত্য মনীষী লুইস গোল্ডিং-এর তথ্যানুসন্ধান মূলক ভ্রমণ
কাহিনী IN THE STEPS OF MOSSES, THE LAW GIVER -এর বরাতে লিখেছেন যে, ওটা
ছিল ‘লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হরদ’। মিসরের আধুনিক তাফসীরকার তানতাভীও
(মৃঃ ১৯৪০ খৃঃ) বলেন যে, লোহিত সাগরে ডুবে মরা ফেরাঊনের লাশ ১৯০০
খৃষ্টাব্দের মে মাসে পাওয়া গিয়েছিল’।[31] যদিও তা ১৯০৭ সালে পাওয়া যায়।[32]
উল্লেখ্য যে, হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর বারো জন পুত্র
মিসরে এসেছিলেন। পরবর্তী চারশত বছরে তাদের বংশ বৃদ্ধি পেয়ে ইস্রাঈলী
বর্ণনা অনুযায়ী ছয় লাখ ৩০ হাযার ছাড়িয়ে যায়। মাওলানা মওদূদী বলেন, ঐ সময়
মিসরে মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা ছিল ১০ থেকে ২০ শতাংশের মাঝামাঝি।[33] তবে কুরআন ও হাদীছ থেকে কেবল এতটুকু জানা যায় যে, তাদের বারোটি গোত্র ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রের জনসংখ্যা ছিল বিপুল।
মূসার নবুঅতী জীবনে এটি ছিল একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা।
ইবরাহীমের অগ্নি পরীক্ষার ন্যায় এটিও ছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক মহা
পরীক্ষা। পিছনে ফেরাঊনের হিংস্র বাহিনী, সম্মুখে অথৈ সাগর। এই কঠিন সময়ে
বনু ইস্রাঈলের আতংক ও হাহাকারের মধ্যেও মূসা ছিলেন স্থির ও নিস্কম্প। দৃঢ়
হিমাদ্রির ন্যায় তিনি আল্লাহর উপরে বিশ্বাসে অটল থাকেন এবং সাথীদের
সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহর রহমত কামনা করেন। হিজরতের রাতে একইরূপ জীবন-মরণ
পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)।
যাই হোক ফেরাঊন খবর জানতে পেরে তার সেনাবাহিনীকে বনু ইস্রাঈলদের পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিল। আল্লাহ বলেন,
فَأَتْبَعُوهُم مُّشْرِقِينَ- فَلَمَّا
تَرَاءى الْجَمْعَانِ قَالَ أَصْحَابُ مُوسَى إِنَّا لَمُدْرَكُونَ-
قَالَ كَلاَّ إِنَّ مَعِيَ رَبِّي سَيَهْدِينِ- فَأَوْحَيْنَا إِلَى
مُوسَى أَنِ اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْبَحْرَ فَانفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ
فِرْقٍ كَالطَّوْدِ الْعَظِيمِ- وَأَزْلَفْنَا ثَمَّ الْآخَرِينَ-
وَأَنجَيْنَا مُوسَى وَمَن مَّعَهُ أَجْمَعِينَ- ثُمَّ أَغْرَقْنَا
الْآخَرِينَ- (الشعراء ৬০-৬৬)-
‘সূর্যোদয়ের সময় তারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল’ (শো‘আরা ২৬/৬০)। ‘অতঃপর যখন উভয় দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসার সঙ্গীরা (ভীত হয়ে) বলল, إِنَّا لَمُدْرَكُونَ ‘আমরা তো এবার নিশ্চিত ধরা পড়ে গেলাম’ (৬১)। ‘তখন মূসা বললেন, কখনই নয়, আমার সাথে আছেন আমার পালনকর্তা। তিনি আমাকে সত্বর পথ প্রদর্শন করবেন’(৬২)।
‘অতঃপর আমরা মূসাকে আদেশ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর। ফলে
তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পাহাড় সদৃশ হয়ে গেল’(৬৩)। ‘ইতিমধ্যে আমরা সেখানে অপরদলকে (অর্থাৎ ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনীকে) পৌঁছে দিলাম’(৬৪)। ‘এবং মূসা ও তার সঙ্গীদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলাম’(৬৫)। ‘অতঃপর অপর দলটিকে ডুবিয়ে দিলাম’ (শো‘আরা ২৬/৬০-৬৬)।
এখানে ‘প্রত্যেক ভাগ’ বলতে তাফসীরকারগণ বারো গোত্রের
জন্য বারোটি ভাগ বলেছেন। প্রত্যেক ভাগের লোকেরা পানির দেওয়াল ভেদ করে
পরস্পরকে দেখতে পায় ও কথা বলতে পারে, যাতে তারা ভীত না হয়ে পড়ে। আমরা মনে
করি এগুলো কল্পনা না করলেও চলে। বরং উপরে বর্ণিত কুরআনী বক্তব্যের উপরে
ঈমান আনাই যথেষ্ট। সাড়ে ছয় লক্ষ লোক এবং তাদের সওয়ারী ও গবাদি পশু ও
সাংসারিক দ্রব্যাদি নিয়ে নদী পার হবার জন্য যে বিরাট এলাকা প্রয়োজন, সেই
এলাকাটুকু বাদে দু’পাশে দু’ভাগে যদি সাময়িকভাবে পানি দাঁড়িয়ে থাকে, তবে
সেটাতে বিশ্বাস করাই শ্রেয়। ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়া ও
শ্রীলংকার সাগরে যে ‘সুনামী’ (TSUNAMI) হয়ে গেল, তাতে ৩৩ ফুট উঁচু ঢেউ
দীর্ঘ সময় যাবত দাঁড়িয়ে ছিল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাই মূসার
যামানায় সাগর বিদীর্ণ হয়ে তলদেশ থেকে দু’পাশে পানি দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই
বিচিত্র নয়। আল্লাহর হুকুমে সবকিছুই হওয়া সম্ভব।
মূসা ও বনু ইস্রাঈলকে সাগর পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যেতে
দেখে ফেরাঊন সরোষে ঘোড়া দাবড়িয়ে সর্বাগ্রে শুষ্ক সাগর বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
পিছনে তার বিশাল বাহিনীর সবাই সাগরের মধ্যে নেমে এলো। যখন তারা সাগরের
মধ্যস্থলে পৌঁছে গেল, তখন আল্লাহর হুকুমে দু’দিক থেকে বিপুল পানি রাশি
ধেয়ে এসে তাদেরকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলল। আল্লাহ বলেন, فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ بِجُنُودِهِ فَغَشِيَهُم مِّنَ الْيَمِّ مَا غَشِيَهُمْ- (طه ৭৮)- ‘অতঃপর ফেরাঊন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। কিন্তু সমুদ্র তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলল’ (ত্বোয়াহা ২০/৭৮)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ
الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُودُهُ بَغْياً وَعَدْواً
حَتَّى إِذَا أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ آمَنتُ أَنَّهُ لآ إِلَهَ
إِلاَّ الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ
الْمُسْلِمِينَ- (يونس ৯০)-
‘আর বনু ইস্রাঈলকে আমরা সাগর পার করে দিলাম। তারপর
তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনী বাড়াবাড়ি ও শত্রুতা বশতঃ।
অতঃপর যখন সে (ফেরাঊন) ডুবতে লাগল, তখন বলে উঠল, আমি ঈমান আনছি এ বিষয়ে
যে, সেই সত্তা ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যার উপরে ঈমান এনেছে বনু ইস্রাঈলগণ
এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের একজন’ (ইউনুস ১০/৯০)। আল্লাহ বললেন,
آلآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنتَ
مِنَ الْمُفْسِدِينَ- فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ
لِمَنْ خَلْفَكَ آيَةً وَإِنَّ كَثِيراً مِّنَ النَّاسِ عَنْ آيَاتِنَا
لَغَافِلُونَ- (يونس ৯১-৯২)-
آلآن
‘এখন একথা বলছ? অথচ তুমি ইতিপূর্বে না-ফরমানী করেছিলে এবং ফাসাদ
সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে’। ‘অতএব আজ আমরা তোমার দেহকে (বিনষ্ট হওয়া
থেকে) বাঁচিয়ে দিচ্ছি। যাতে তোমার পশ্চাদ্বর্তীদের জন্য তুমি নিদর্শন
হ’তে পার। বস্ত্ততঃ বহু লোক এমন রয়েছে যারা আমাদের নিদর্শনাবলীর বিষয়ে
বেখবর’ (ইউনুস ১০/৯১-৯২)।
স্মর্তব্য যে, সাগরডুবির দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার পরেও
ভীত-সন্ত্রস্ত বনু ইস্রাঈলীরা ফেরাঊন মরেছে কি-না বিশ্বাস করতে পারছিল না।
ফলে মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট দো‘আ করলেন। তখন আল্লাহ তার প্রাণহীন দেহ বের
করে দিলেন। অতঃপর মূসার সাথীরা নিশ্চিন্ত হ’ল।[34]
উল্লেখ্য যে, ফেরাঊনের মমিকৃত দেহ অক্ষতভাবে পাওয়া যায় ১৯০৭ সালে এবং বর্তমানে তা মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
এতে একথাও প্রমাণিত হয় যে, ফেরাঊনের সময় মিসরীয়
সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল। তাদের সময়ে লাশ ‘মমি’ করার মত বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল
আবিষ্কৃত হয়। পিরামিড, স্ফিংক্স হাযার হাযার বছর ধরে আজও সেই প্রাচীন
সভ্যতার স্মৃতি ধারণ করে আছে, যা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। আজকের যুগের কোন
কারিগর প্রাচীন এসব কারিগরী কলা-কৌশলের ধারে-কাছেও যেতে পারবে কি-না
সন্দেহ।
ফেরাঊনের সাগরডুবি ও মূসার মুক্তি লাভের এ অলৌকিক
ঘটনাটি ঘটেছিল ১০ই মুহাররম আশূরার দিন। এ দিনের স্মরণে আল্লাহর শুকরিয়া
স্বরূপ মূসা (আঃ) ও বনু ইস্রাঈলগণ প্রতি বছর এ দিন একটি নফল ছিয়াম পালন
করেন। এই ছিয়াম যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। জাহেলী আরবেও এ ছিয়াম চালু ছিল।
নবুঅত-পূর্ব কালে ও পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আশূরার ছিয়াম রাখতেন। ২রা
হিজরীতে রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আশূরার ছিয়াম মুসলমানদের
জন্য ‘ফরয’ ছিল। এরপরে এটি নফল ছিয়ামে পরিণত হয়।[35]
হিজরতের পর মদীনায় ইহুদীদের এ ছিয়াম পালন করতে দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বললেন, আমরাই মূসা (আঃ)-এর নাজাতে শুকরিয়া আদায় করার অধিক হকদার। আগামী
বছর বেঁচে থাকলে আমি ৯ তারিখে (অর্থাৎ ৯ ও ১০ দু’দিন) ছিয়াম পালন করব’।[36] অন্য হাদীছে ১০ ও ১১ দু’দিন ছিয়াম পালনের কথাও এসেছে।[37]
অতএব নাজাতে মূসার শুকরিয়া আদায়ের নিয়তে নফল ছিয়াম হিসাবে ১০ তারিখ সহ
উক্ত দু’দিন অথবা কেবল ১০ই মুহাররম তারিখে আশূরার ছিয়াম পালন করা প্রত্যেক
মুসলমানের জন্য কর্তব্য। এ ছিয়ামের ফলে মুমিনের বিগত এক বছরের সকল ছগীরা
গুনাহ মাফ হয়ে যাবার কথা হাদীছে এসেছে।[38]
উল্লেখ্য যে, ১০ই মুহাররম তারিখে পৃথিবীতে আরও বহু
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ন্যায় ৬১ হিজরী সনে হযরত হোসায়েন (রাঃ)-এর মর্মান্তিক
শাহাদাতের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু সেজন্য নফল ছিয়াম পালনের বা কোন অনুষ্ঠান বা
দিবস পালনের বিধান ইসলামে নেই। অতএব আশূরার ছিয়াম পালনের নিয়ত হবে
‘নাজাতে মূসার শুকরিয়া’ হিসাবে, ‘শাহাদাতে হোসায়েন-এর শোক’ হিসাবে নয়।
এরূপ নিয়ত করলে নেকীর বদলে গোনাহ হবে।
আল্লাহ বলেন,
فَانتَقَمْنَا مِنْهُمْ فَأَغْرَقْنَاهُمْ
فِي الْيَمِّ بِأَنَّهُمْ كَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا وَكَانُوْا عَنْهَا
غَافِلِيْنَ- وَأَوْرَثْنَا الْقَوْمَ الَّذِيْنَ كَانُوْا
يُسْتَضْعَفُوْنَ مَشَارِقَ الأَرْضِ وَمَغَارِبَهَا الَّتِيْ بَارَكْنَا
فِيهَا وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ الْحُسْنَى عَلَى بَنِي
إِسْرَائِيلَ بِمَا صَبَرُوْا وَدَمَّرْنَا مَا كَانَ يَصْنَعُ فِرْعَوْنُ
وَقَوْمُهُ وَمَا كَانُوْا يَعْرِشُوْنَ- (الأعراف ১৩৬-১৩৭)-
‘ফলে
আমরা তাদের কাছ থেকে (অর্থাৎ ফেরাঊনীদের কাছ থেকে) বদলা নিলাম ও তাদেরকে
সাগরে ডুবিয়ে মারলাম। কারণ তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল আমাদের নিদর্শন
সমূহকে ও তার প্রতি অনীহা প্রদর্শন করেছিল’। ‘আর যাদেরকে দুর্বল মনে করা
হ’ত, তাদেরকে আমরা উত্তরাধিকার দান করলাম সেই ভূখন্ডের পূর্বের ও
পশ্চিমের, যাতে আমরা বরকত নিহিত রেখেছি এবং এভাবে পূর্ণ হয়ে গেল তোমার
প্রভুর (প্রতিশ্রুত) কল্যাণময় বাণীসমূহ বনু ইস্রাঈলীদের জন্য তাদের
ধৈর্যধারণের কারণে। আর ধ্বংস করে দিলাম সে সবকিছু, যা তৈরী করেছিল ফেরাঊন ও
তার সম্প্রদায় এবং যা কিছু তারা নির্মাণ করেছিল’ (আ‘রাফ ৭/১৩৬-১৩৭)।
উপরোক্ত আয়াত দু’টিতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি পরিস্ফূট
হয়। (১) অহংকার ও সীমালংঘনের কারণে ফেরাঊন ও তার সাথীদেরকে ডুবিয়ে মারা হয়
এবং তাদের সভ্যতার সুউচ্চ নির্মাণাদি ধ্বংস হয় (২) আল্লাহর উপরে পূর্ণ
আস্থা ও ফেরাউনের যুলুমে ধৈর্যধারণের পুরস্কার হিসাবে বনু ইস্রাঈলগণকে
উদয়াচল ও অস্তাচল সমূহের উপরে কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। (৩) এখানে الَّذِينَ كَانُوْا يُسْتَضْعَفُونَ
‘যাদেরকে হীন মনে করা হয়েছিল’ বলা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে,
আল্লাহ তা‘আলা যে জাতির বা যে ব্যক্তির সহায় থাকেন, বাহ্যিক অবস্থাদৃষ্টে
লোকেরা তাদের দুর্বল ভেবে বসে। কিন্তু আসলে তারা মোটেই হীন ও দুর্বল নয়।
কারণ প্রকৃত শক্তি ও মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে। এখানে বাহ্যিক
দৃষ্টিতে ফেরাঊন সবল হ’লেও আল্লাহর সাহায্য পাওয়ায় বনু ইস্রাঈলগণ অবশেষে
বিজয়ী হয়েছে। এ কারণে হযরত হাসান বছরী বলেন, অত্র আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে এ
বিষয়ে যে, মানুষ যদি এমন কোন লোক বা দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়,
যাকে প্রতিহত করা তার ক্ষমতার বাইরে, তবে সে ক্ষেত্রে কৃতকার্যতা ও
কল্যাণের সঠিক পথ হ’ল তার মুকাবিলা না করে ছবর করা। কেননা যখন সে যুলুমের
পাল্টা যুলুমের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেবার চিন্তা করে, আল্লাহ তখন তাকে তার
শক্তি-সামর্থ্যের উপরে ছেড়ে দেন। পক্ষান্তরে যখন সে তার মুকাবিলায় ছবর করে
এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে, তখন আল্লাহ স্বয়ং তার জন্য রাস্তা
খুলে দেন’।
বনু ইস্রাঈলগণ মূসা (আঃ)-এর পরামর্শে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিল, رَبَّنَا لاَ تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِّلْقَوْمِ الظَّالِمِينَ، وَنَجِّنَا بِرَحْمَتِكَ مِنَ الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এ যালেম কওমের ফেৎনায় নিক্ষেপ করো না’।
‘এবং আমাদেরকে অনুগ্রহ করে কাফের সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (ইউনুস ১০/৮৫-৮৬)। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তাদের প্রার্থনা কবুল করেছিলেন এবং যথাসময়ে তাদের মুক্তি দিয়েছিলেন।
এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল, সাগরডুবি থেকে নাজাত পেয়েই কি বনু
ইস্রাঈলগণ মিসরে প্রত্যাবর্তন করল এবং ফেরাঊনের অট্টালিকা সমূহ ধ্বংস করে
ফেরাঊনী রাজত্বের মালিক বনে গেল? এ ব্যাপারে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে
উল্লেখিত এতদসংক্রান্ত আয়াত সমূহে প্রমাণিত হয় যে, মূসা (আঃ) ও বনু
ইস্রাঈলগণ ঐসময় মিসরে ফিরে যাননি। বরং তাঁরা আদি বাসস্থান কেন‘আনের
উদ্দেশ্যে শাম-এর দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন। অতঃপর পথিমধ্যে তাদেরকে নির্দেশ
দেওয়া হয় জিহাদ করে তাদের আদি বাসস্থান কেন‘আন দখল করার জন্য। সেখানে তখন
আমালেক্বাদের রাজত্ব ছিল। যারা ছিল বিগত ‘আদ বংশের লোক এবং বিশালদেহী ও
দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। নবী মূসার মাধ্যমে আল্লাহ তাদের আগাম বিজয়ের সুসংবাদ
দেন। তথাপি তারা ভীত হয় এবং জিহাদে যেতে অস্বীকার করে। শক্তিশালী ফেরাঊন ও
তার বিশাল বাহিনীর চাক্ষুস ধ্বংস দেখেও তারা আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা
করতে পারেনি। ফলে আল্লাহর অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ মিসর ও শামের মধ্যবর্তী
তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত জেলখানায় তারা ৪০ বছর অবরুদ্ধ জীবন অতিবাহিত
করতে বাধ্য হয় এবং সেখানে থাকা অবস্থাতেই হারূণ ও মূসা (আঃ)-এর মৃত্যু হয়।
পরবর্তীতে মূসা (আঃ)-এর শিষ্য ও পরবর্তী নবী ইউশা‘ বিন নূন-এর নেতৃত্বে
তারা জিহাদে অগ্রসর হয় এবং তার মাধ্যমে আমালেক্বাদের হারিয়ে কেন‘আন দখল
করে তারা তাদের আদি বাসস্থানে ফিরে আসে। এভাবে আল্লাহর ওয়াদা সত্যে পরিণত
হয়।
উল্লেখ্য যে, আলোচ্য সূরা আ‘রাফ ১৩৬-৩৭ আয়াত ছাড়াও
শো‘আরা ৫৯, ক্বাছাছ ৫ ও দুখান ২৫-২৮ আয়াত সমূহে বাহ্যতঃ ইঙ্গিত পাওয়া যায়
যে, বনু ইস্রাঈলগণকে ফেরাঊনীদের পরিত্যক্ত সম্পদ সমূহের মালিক করা হয়েছিল।
কিন্তু সেখানে এ বিষয়েরও সুস্পষ্ট অবকাশ বিদ্যমান রয়েছে যে, বনু
ইস্রাঈলগণকে ফেরাঊনীদের ন্যায় বাগ-বাগিচা ও ধন-সম্পদের মালিক করা হয়েছিল।
এর জন্য তাদের মিসরে প্রত্যাবর্তন করা যরূরী নয়। বরং অনুরূপ বাগ-বাগিচা
শাম দেশেও অর্জিত হ’তে পারে। সূরা আ‘রাফের আলোচ্য ১৩৭ আয়াতে ‘যাতে আমরা
বরকত নিহিত রেখেছি’ বলে শাম দেশকে বুঝানো হয়েছে। একই বাক্য সূরা বনু
ইস্রাঈলের ১ম আয়াতেও বলা হয়েছে। সেকারণ ক্বাতাদাহ বলেন, উপরোক্ত মর্মের
সকল আয়াতে শাম দেশকে বুঝানো হয়েছে। যেখানে গিয়ে বনু ইস্রাঈলগণ দুনিয়াবী
শান-শওকতের মালিক হয়। পূর্বের ও পশ্চিমের বলে শামের চারপাশ বুঝানো হয়েছে।
হ’তে পারে এ সময় মাশারেক্ব ও মাগারেব (পূর্ব ও পশ্চিম) তথা শাম ও মিসর
উভয় ভূখন্ডের উপরে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।[39]
প্রশ্ন হয়, ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনী সমূলে ধ্বংস
হওয়ার পরও হযরত মূসা (আঃ) কেন মিসরে ফিরে গিয়ে তার সিংহাসন দখল করে বনু
ইস্রাঈলের শাসন প্রতিষ্ঠা করলেন না? এর জবাব প্রথমতঃ এটাই যে, এ ব্যাপারে তিনি আল্লাহর নির্দেশ পাননি। দ্বিতীয়তঃ
তাঁর দূরদর্শিতায় হয়ত এটাই প্রতীয়মান হয়েছিল যে, রাজনৈতিক বিজয়ের মাধ্যমে
প্রকৃত অর্থে দ্বীনের বিজয় সম্ভব নয়। তাছাড়া দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্য
রাজনৈতিক সীমানা শর্ত নয়; বরং তা অঞ্চলগত সীমানা পেরিয়ে সর্বত্র প্রচার
আবশ্যক। তাই তিনি মিসর এলাকায় দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব পালন শেষে এবার শাম
এলাকায় দ্বীন প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। তৃতীয়তঃ এটা হ’তে
পারে যে, নবীগণের পিতা ইবরাহীম (আঃ) সহ বনু ইস্রাঈলের মূল ব্যক্তি হযরত
ইয়াকূব (আঃ) ও অন্যান্য নবীগণের জন্মস্থান শাম এলাকার বরকতমন্ডিত অঞ্চলে
জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো ব্যয় করার সুপ্ত বাসনা তাঁর মধ্যে কাজ করে থাকতে
পারে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ পাক তাঁর মৃত্যুর জন্য কেন‘আনের মাটিকেই নির্ধারিত
করেছিলেন এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে
একটি লাল ঢিবি দেখিয়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর কবর নির্দেশ করেছিলেন।[40]
উপরোক্ত আলোচনার উপসংহারে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে
পারি যে, সাগরডুবি থেকে নাজাত পাবার পর মূসা (আঃ) ও বনু ইস্রাঈলগণ তখনই
মিসরে ফিরে যাননি। বরং তারা কেন‘আনের উদ্দেশ্যে শাম অভিমুখে রওয়ানা
হয়েছিলেন। শামে যাত্রাপথে এবং সেখানে পৌঁছে তাদেরকে নানাবিধ পরীক্ষার
সম্মুখীন হ’তে হয়। এক্ষণে আমরা সেদিকে মনোনিবেশ করব।
বনু ইস্রাঈল কওম মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযার বলে লোহিত
সাগরে নির্ঘাত ডুবে মরা থেকে সদ্য নাজাত পেয়ে এসেছিল এবং গোটা ফেরাঊনী
গোষ্ঠীকে সাগরে ডুবে মরার মর্মান্তিক দৃশ্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে
এসেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিরিয়া আসার পথে কিছুদূর অগ্রসর হ’তেই তারা
এমন এক জনপদের উপর দিয়ে অতিক্রম করল, যারা বিভিন্ন মূর্তির পূজায় লিপ্ত
ছিল। তাদের পূজা-অর্চনার জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে তাদের মন সেদিকে
আকৃষ্ট হ’ল এবং মূসা (আঃ)-এর কাছে গিয়ে আবেদন করল, اجْعَل لَّنَا إِلَـهاً كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ ‘তাদের মূর্তিসমূহের ন্যায় আমাদের জন্যও একটা মূর্তি বানিয়ে দিন’। মূসা বললেন, إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ ‘তোমরা দেখছি মূর্খতায় লিপ্ত জাতি’। তিনি বলেন, إِنَّ هَـؤُلاء مُتَبَّرٌ مَّا هُمْ فِيهِ وَبَاطِلٌ مَّا كَانُوْا يَعْمَلُونَ ‘এরা যে কাজে নিয়োজিত রয়েছে, তা ধ্বংস হবে এবং যা কিছু তারা করছে, তা সব বাতিল’। ‘তিনি আরও বললেন, أَغَيْرَ اللهِ أَبْغِيْكُمْ إِلَـهاً ‘আমি কি তোমাদের জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য সন্ধান করব? অথচ তিনি তোমাদেরকে সারা বিশ্বের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন’ (আ‘রাফ ৭/১৩৮-১৪০)।
বস্ত্ততঃ মানুষ সর্বদা আনুষ্ঠানিকতা প্রিয় এবং অদৃশ্য
সত্তার চেয়ে দৃশ্যমান বস্ত্তর প্রতি অধিকতর আসক্ত। ফলে নূহ (আঃ)-এর যুগ
থেকেই অদৃশ্য আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের অসীলা কল্পনা করে নিজেদের হাতে গড়া
দৃশ্যমান মূর্তি সমূহের পূজা-অর্চনা চলে আসছে। অবশেষে আল্লাহ্কে ও তাঁর
বিধানকে ভুলে গিয়ে মানুষ মূর্তিকে ও নিজেদের মনগড়া বিধানকে মুখ্য গণ্য
করেছে। মক্কার মুশরিকরাও শেষনবীর কাছে তাদের মূর্তিপূজাকে আল্লাহর
নৈকট্যের অসীলা বলে অজুহাত দিয়েছিল’ (যুমার ৩৯/৩)। তাদের এই
অজুহাত অগ্রাহ্য হয় এবং তাদের রক্ত হালাল গণ্য হয়। বদর, ওহোদ, খন্দক
প্রভৃতি যুদ্ধসহ পরবর্তীকালের সকল জিহাদ মূলতঃ এই শিরকের বিরুদ্ধেই
পরিচালিত হয়। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে মূর্তি ভেঙ্গে
অতঃপর পানি দিয়ে ধুয়ে কা‘বা গৃহ ছাফ করেন এবং আয়াত পাঠ করেন, جَاء الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ ‘সত্য এসে গেল, মিথ্যা বিদূরিত হ’ল’ (ইসরা ১৭/৮১)।
কিন্তু দুর্ভাগ্য! মূর্তিপূজার সে স্থান আজ দখল
করেছে মুসলমানদের মধ্যে কবর পূজা, ছবি-মূর্তি ও প্রতিকৃতি পূজা,
স্মৃতিসৌধ, স্থানপূজা, শহীদ মিনার ও বেদী পূজা, শিখা ও আগুন পূজা ইত্যাদি।
বস্ত্ততঃ এগুলি স্পষ্ট শিরক, যা থেকে নবীগণ যুগে যুগে মানুষকে সাবধান
করেছেন। মূসা (আঃ) স্বীয় কওমকে তাদের মূর্খতাসূলভ আচরণের জন্য ধমকানোর পর
তাদের হুঁশ ফিরলো এবং তারা বিরত হ’ল।
অতঃপর আল্লাহ মূসাকে অহীর মাধ্যমে ওয়াদা করলেন যে,
তাকে সত্বর ‘কিতাব’ (তওরাত) প্রদান করা হবে এবং এজন্য তিনি বনু ইস্রাঈলকে
সাথে নিয়ে তাকে ‘তূর পাহাড়ের দক্ষিণ পার্শ্বে’ চলে আসতে বললেন (ত্বোয়াহা ২০/৮৩-৮৪)। অতঃপর মূসা (আঃ) আগে এসে আল্লাহর হুকুমে প্রথমে ত্রিশ দিন ছিয়াম ও এ‘তেকাফে মগ্ন থাকেন। এরপর আল্লাহ আরও দশদিন মেয়াদ বাড়িয়ে দেন (আ‘রাফ ৭/১৪২)।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,& এই দশদিন ছিল যিলহজ্জের প্রথম দশদিন, যা
অতীব বরকতময়। ইবনু কাছীর বলেন, ১০ই যিলহজ্জ কুরবানীর দিন মূসার মেয়াদ শেষ
হয় ও আল্লাহর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য লাভ হয়। একই দিন শেষনবী মুহাম্মাদ
(ছাঃ)-এর উপর দ্বীন পরিপূর্ণতার আয়াত নাযিল হয় (মায়েদাহ ৩)।=( ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আ‘রাফ ১৪২)।
যথাসময়ে আল্লাহ মূসার সঙ্গে কথা বললেন (আ‘রাফ ৭/১৪৩)। অতঃপর তাঁকে তওরাত প্রদান করলেন, যা ছিল সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী ও সরল পথ প্রদর্শনকারী (বাক্বারাহ ২/৫৩)।
দীর্ঘ বিশ বছরের অধিককাল পূর্বে মিসর যাওয়ার পথে এই স্থানেই মূসা প্রথম
আল্লাহর সাথে কথোপকথনের ও নবুঅত লাভের মহা সৌভাগ্য লাভ করেন। আজ আবার
সেখানেই বাক্যালাপ ছাড়াও এলাহী গ্রন্থ তওরাত পেয়ে খুশীতে অধিকতর সাহসী হয়ে
তিনি আল্লাহর নিকটে দাবী করে বসলেন,
رَبِّ أَرِنِي أَنظُرْ إِلَيْكَ قَالَ
لَنْ تَرَانِي وَلَـكِنِ انظُرْ إِلَى الْجَبَلِ فَإِنِ اسْتَقَرَّ
مَكَانَهُ فَسَوْفَ تَرَانِي، فَلَمَّا تَجَلَّى رَبُّهُ لِلْجَبَلِ
جَعَلَهُ دَكًّا وََّخَرَّ مُوسَى صَعِقًا- فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ
سُبْحَانَكَ تُبْتُ إِلَيْكَ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُؤْمِنِينَ- (الأعراف
১৪৩)-
‘হে
আমার পালনকর্তা! আমাকে দেখা দাও। আমি তোমাকে স্বচক্ষে দেখব। আল্লাহ
বললেন, তুমি আমাকে (এ দুনিয়াতে) কখনোই দেখতে পাবে না। তবে তুমি (তূর)
পাহাড়ের দিকে দেখতে থাক। সেটি যদি স্বস্থানে স্থির থাকে, তাহ’লে তুমি
আমাকে দেখতে পাবে। অতঃপর যখন তার প্রভু উক্ত পাহাড়ের উপরে স্বীয় জ্যোতির
বিকীরণ ঘটালেন, সেটিকে বিধ্বস্ত করে দিলেন এবং মূসা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল।
অতঃপর যখন তার জ্ঞান ফিরে এল, তখন বলল, হে প্রভু! মহা পবিত্র তোমার সত্তা!
আমি তোমার নিকটে তওবা করছি এবং আমি বিশ্বাসীদের মধ্যে অগ্রণী’ (আ‘রাফ ৭/১৪৩)।
আল্লাহ বললেন,
قَالَ يَا مُوسَى
إِنِّي اصْطَفَيْتُكَ عَلَى النَّاسِ بِرِسَالاَتِي وَبِكَلاَمِيْ فَخُذْ
مَا آتَيْتُكَ وَكُنْ مِنَ الشَّاكِرِيْنَ (144) وَكَتَبْنَا لَهُ فِي
الْأَلْوَاحِ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ مَوْعِظَةً وَتَفْصِيْلاً لِكُلِّ شَيْءٍ
فَخُذْهَا بِقُوَّةٍ وَأْمُرْ قَوْمَكَ يَأْخُذُوا بِأَحْسَنِهَا
سَأُرِيْكُمْ دَارَ الْفَاسِقِيْنَ (الأعراف 144-145)- হে
মূসা! আমি আমার ‘রিসালাত’ তথা বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে এবং বাক্যালাপের
মাধ্যমে লোকদের (নবীগণের) উপরে তোমাকে বিশিষ্টতা দান করেছি। সুতরাং যা
কিছু আমি তোমাকে দান করলাম তা গ্রহণ কর ও কৃতজ্ঞ থাক’। ‘আর আমরা তার জন্য
ফলক সমূহে লিখে দিয়েছিলাম সর্বপ্রকার উপদেশ ও সকল বিষয় বিস্তারিতভাবে। অতএব
তুমি এগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং স্বজাতিকে এর কল্যাণকর বিষয়সমূহ দৃঢ়তার
সাথে পালনের নির্দেশ দাও। শীঘ্রই আমি তোমাদেরকে দেখাব পাপাচারীদের
বাসস্থান’ (আ‘রাফ ৭/১৪৪-১৪৫)।
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, তখতী বা ফলকে লিখিত অবস্থায় তাঁকে কিতাব প্রদান করা হয়েছিল। আর এই তখতীগুলোর নামই হ’ল ‘তওরাত’।
মূসা যখন বনী ইস্রাঈলকে নিয়ে তূর পাহাড়ের দিকে
রওয়ানা হয়ে গেলেন। তখন তিনি হারূণ (আঃ)-কে কওমের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন এবং
তাদেরকে পশ্চাতে আসার নির্দেশ দিয়ে নিজে আগে চলে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে ৪০
দিন ছিয়াম ও ই‘তেকাফে কাটানোর পরে তওরাত লাভ করলেন। তাঁর ধারণা ছিল যে,
তার কওম নিশ্চয়ই তার পিছে পিছে তূর পাহাড়ের সন্নিকটে এসে শিবির স্থাপন
করেছে। কিন্তু তাঁর ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল।
আল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, وَمَا
أَعْجَلَكَ عَنْ قَوْمِكَ يَا مُوْسَى- قَالَ هُمْ أُولاَءِ عَلَى
أَثَرِي وَعَجِلْتُ إِلَيْكَ رَبِّ لِتَرْضَى- قَالَ فَإِنَّا قَدْ
فَتَنَّا قَوْمَكَ مِنْ بَعْدِكَ وَأَضَلَّهُمُ السَّامِرِيُّ- (طه
83-85)- ‘হে
মূসা! তোমার সম্প্রদায়কে পিছনে ফেলে তুমি দ্রুত চলে এলে কেন?’ ‘তিনি
বললেন, তারা তো আমার পিছে পিছেই আসছে এবং হে প্রভু! আমি তাড়াতাড়ি তোমার
কাছে এলাম, যাতে তুমি খুশী হও’। আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমার সম্প্রদায়কে
পরীক্ষা করেছি তোমার পর এবং সামেরী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৩-৮৫)।
একথা জেনে মূসা (আঃ) হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং দুঃখে ও ক্ষোভে অস্থির হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
فَرَجَعَ مُوْسَى إِلَى
قَوْمِهِ غَضْبَانَ أَسِفًا قَالَ يَا قَوْمِ أَلَمْ يَعِدْكُمْ
رَبُّكُمْ وَعْدًا حَسَنًا أَفَطَالَ عَلَيْكُمُ الْعَهْدُ أَمْ
أَرَدْتُمْ أَنْ يَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ
فَأَخْلَفْتُمْ مَوْعِدِي- قَالُوا مَا أَخْلَفْنَا مَوْعِدَكَ بِمَلْكِنَا
وَلَكِنَّا حُمِّلْنَا أَوْزَارًا مِّنْ زِيْنَةِ الْقَوْمِ
فَقَذَفْنَاهَا فَكَذَلِكَ أَلْقَى السَّامِرِيُّ- فَأَخْرَجَ لَهُمْ
عِجْلاً جَسَدًا لَهُ خُوَارٌ فَقَالُوا هَذَا إِلَهُكُمْ وَإِلَهُ مُوسَى
فَنَسِيَ- (طه 86-88)- ‘অতঃপর
মূসা তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলেন ক্রুদ্ধ ও অনুতপ্ত অবস্থায়। তিনি
বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের পালনকর্তা কি তোমাদের একটি উত্তম
প্রতিশ্রুতি (অর্থাৎ তওরাৎ দানের প্রতিশ্রুতি) দেননি? তবে কি প্রতিশ্রুতির
সময়কাল (৪০ দিন) তোমাদের কাছে দীর্ঘ হয়েছে? না-কি তোমরা চেয়েছ যে তোমাদের
উপর তোমাদের পালনকর্তার ক্রোধ নেমে আসুক, যে কারণে তোমরা আমার সাথে কৃত
ওয়াদা ভঙ্গ করলে’? (৮৬) ‘তারা বলল, আমরা আপনার সাথে কৃত ওয়াদা
স্বেচ্ছায় ভঙ্গ করিনি। কিন্তু আমাদের উপরে ফেরাঊনীদের অলংকারের বোঝা
চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর আমরা তা নিক্ষেপ করে দিয়েছি এমনিভাবে সামেরীও
নিক্ষেপ করেছে’(৮৭)। ‘অতঃপর সে তাদের জন্য (সেখান থেকে) বের করে
আনলো একটা গো-বৎসের অবয়ব, যার মধ্যে হাম্বা হাম্বা রব ছিল। অতঃপর (সামেরী ও
তার লোকেরা) বলল, এটাই তোমাদের উপাস্য এবং মূসারও উপাস্য, যা পরে মূসা
ভুলে গেছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৬-৮৮)।
ঘটনা ছিল এই যে, মিসর থেকে বিদায়ের দিন যাতে
ফেরাঊনীরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন না করে এবং তারা কোনরূপ সন্দেহ না করে,
সেজন্য (মূসাকে লুকিয়ে) বনু ইস্রাঈলরা প্রতিবেশী ক্বিবতীদের কাছ থেকে
অলংকারাদি ধার নেয় এই কথা বলে যে, আমরা সবাই ঈদ উৎসব পালনের জন্য যাচ্ছি।
দু’একদিনের মধ্যে ফিরে এসেই তোমাদের সব অলংকার ফেরৎ দিব। কিন্তু সাগর পার
হওয়ার পর যখন আর ফিরে যাওয়া হ’ল না, তখন কুটবুদ্ধি ও মূসার প্রতি কপট
বিশ্বাসী সামেরী মনে মনে এক ফন্দি আটলো যে, এর দ্বারা সে বনু ইস্রাঈলদের
পথভ্রষ্ট করবে। অতঃপর মূসা (আঃ) যখন তার সম্প্রদায়কে হারূণের দায়িত্বে
দিয়ে নিজে আগেভাগে তূর পাহাড়ে চলে যান, তখন সামেরী সুযোগ বুঝে তার ফন্দি
কাজে লাগায়। সে ছিল অত্যন্ত চতুর। সাগর ডুবি থেকে নাজাত পাবার সময় সে
জিব্রীলের অবতরণ ও তার ঘোড়ার প্রতি লক্ষ্য করেছিল। সে দেখেছিল যে,
জিব্রীলের ঘোড়ার পা যে মাটিতে পড়ছে, সে স্থানের মাটি সজীব হয়ে উঠছে ও তাতে
জীবনের স্পন্দন জেগে উঠছে। তাই সবার অলক্ষ্যে এ পদচিহ্নের এক মুঠো মাটি
সে তুলে সযতনে রেখে দেয়।
মূসা (আঃ) চলে যাবার পর সে লোকদের বলে যে, ‘তোমরা
ফেরাঊনীদের যেসব অলংকারাদি নিয়ে এসেছ এবং তা ফেরত দিতে পারছ না, সেগুলি
ভোগ-ব্যবহার করা তোমাদের জন্য হালাল হবে না। অতএব এগুলি একটি গর্তে
নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দাও’। কথাটি অবশেষে হারূণ (আঃ)-এর কর্ণগোচর হয়।
নাসাঈ-তে বর্ণিত ‘হাদীছুল ফুতূনে’ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-এর
রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, হযরত হারূণ (আঃ) সব অলংকার একটি গর্তে নিক্ষেপ
করে জ্বালিয়ে দেবার নির্দেশ দেন, যাতে সেগুলি একটি অবয়বে পরিণত হয় এবং
মূসা (আঃ)-এর ফিরে আসার পর এ সম্পর্কে করণীয় নির্ধারণ করা যায়। হযরত হারূণ
(আঃ)-এর নির্দেশ মতে সবাই যখন অলংকার গর্তে নিক্ষেপ করছে, তখন সামেরীও
হাতের মুঠি বন্ধ করে সেখানে পৌঁছল এবং হযরত হারূণ (আঃ)-কে বলল, আমার
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হৌক- এই মর্মে আপনি দো‘আ করলে আমি নিক্ষেপ করব, নইলে নয়।’
হযরত হারূণ তার কপটতা বুঝতে না পেরে সরল মনে দো‘আ করলেন। আসলে তার মুঠিতে
ছিল জিব্রীলের ঘোড়ার পায়ের সেই অলৌকিক মাটি। ফলে উক্ত মাটির প্রতিক্রিয়ায়
হৌক কিংবা হযরত হারূণের দো‘আর ফলে হৌক- সামেরীর উক্ত মাটি নিক্ষেপের
পরপরই গলিত অলংকারাদির অবয়বটি একটি গো-বৎসের রূপ ধারণ করে হাম্বা হাম্বা রব
করতে থাকে। মুনাফিক সামেরী ও তার সঙ্গী-সাথীরা এতে উল্লসিত হয়ে বলে উঠল, هَذَا إِلَهُكُمْ وَإِلَهُ مُوسَى فَنَسِيَ ‘এটাই হ’ল তোমাদের উপাস্য ও মূসার উপাস্য। যা সে পরে ভুলে গেছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৮)।
মূসা (আঃ)-এর তূর পাহাড়ে গমনকে সে অপব্যাখ্যা দিয়ে
বলল, মূসা বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছে। এখন তোমরা সবাই
গো-বৎসের পূজা কর’। কিছু লোক তার অনুসরণ করল। বলা হয়ে থাকে যে, বনু
ইস্রাঈল এই ফিৎনায় পড়ে তিন দলে বিভক্ত হয়ে গেল। ফলে মূসা (আঃ)-এর পিছে পিছে
তূর পাহাড়ে গমনের প্রক্রিয়া পথিমধ্যেই বানচাল হয়ে গেল।
হারূণ (আঃ) তাদেরকে বললেন, وَلَقَدْ
قَالَ لَهُمْ هَارُونُ مِنْ قَبْلُ يَا قَوْمِ إِنَّمَا فُتِنْتُمْ بِهِ
وَإِنَّ رَبَّكُمُ الرَّحْمَنُ فَاتَّبِعُونِي وَأَطِيعُوا أَمْرِي-
قَالُوا لَنْ نَبْرَحَ عَلَيْهِ عَاكِفِينَ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَيْنَا
مُوسَى- (طه 90-91)-
কওম! তোমরা এই গো-বৎস দ্বারা পরীক্ষায় পতিত হয়েছ। তোমাদের পালনকর্তা
অতীব দয়ালু। অতএব তোমরা আমার অনুসরণ কর এবং আমার আদেশ মেনে চল’(৯০)। কিন্তু সম্প্রদায়ের লোকেরা বলল, ‘মূসা আমাদের কাছে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজায় রত থাকব’ (ত্বোয়াহা ২০/৯০-৯১)।
অতঃপর মূসা (আঃ) এলেন এবং সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে
সব কথা শুনলেন। হারূণ (আঃ)ও তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন। সামেরীও তার কপটতার
কথা অকপটে স্বীকার করল। অতঃপর মূসা (আঃ) আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী শাস্তি
ঘোষণা করলেন।
মূসা (আঃ) গো-বৎস পূজায় নেতৃত্ব দানকারী হঠকারী লোকদের মৃত্যুদন্ড দিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলল, وَإِذْ
قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ إِنَّكُمْ ظَلَمْتُمْ أَنْفُسَكُمْ
بِاتِّخَاذِكُمُ الْعِجْلَ فَتُوبُوا إِلَى بَارِئِكُمْ فَاقْتُلُوا
أَنْفُسَكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ عِنْدَ بَارِئِكُمْ... হে
আমার সম্প্রদায়! তোমরা গো-বৎসকে উপাস্য নির্ধারণ করে নিজেদের উপরে যুলুম
করেছ। অতএব এখন তোমাদের প্রভুর নিকটে তওবা কর এবং নিজেদেরকে পরস্পরে হত্যা
কর। এটাই তোমাদের জন্য তোমাদের স্রষ্টার নিকটে কল্যাণকর’... (বাক্বারাহ ২/৫৪)। এভাবে তাদের কিছু লোককে হত্যা করা হয়, কিছু লোক ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়।
এরপরেও কপট বিশ্বাসী ও হঠকারী কিছু লোক থাকে, যারা
তওরাতকে মানতে অস্বীকার করে। ফলে তাদের মাথার উপরে আল্লাহ তূর পাহাড়ের
একাংশ উঁচু করে ঝুলিয়ে ধরেন এবং অবশেষে নিরুপায় হয়ে তারা সবাই আনুগত্য
করতে স্বীকৃত হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,وَإِذْ أَخَذْنَا
مِيْثَاقَكُمْ وَرَفَعْنَا فَوْقَكُمُ الطُّوْرَ خُذُوْا مَا آتَيْنَاكُم
بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُوْا مَا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ- (البقرة
৬৩)-
‘আর যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম
এবং তূর পাহাড়কে তোমাদের মাথার উপরে তুলে ধরেছিলাম এই বলে যে, তোমাদের যে
কিতাব দেওয়া হয়েছে, তা মযবুতভাবে ধারণ কর এবং এতে যা কিছু রয়েছে তা স্মরণে
রাখ, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ২/৬৩)। কিন্তু গো-বৎসের মহববত এদের হৃদয়ে এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, এতকিছুর পরেও তারা শিরক ছাড়তে পারেনি। আল্লাহ বলেন, وَأُشْرِبُواْ فِي قُلُوبِهِمُ الْعِجْلَ بِكُفْرِهِمْ ‘কুফরের কারণে তাদের অন্তরে গোবৎস প্রীতি পান করানো হয়েছিল’ (বাক্বারাহ ২/৯৩)।
যেমন কেউ সরাসরি শিরকে নেতৃত্ব দিয়েছে, কেউবা মুখে তওবা করলেও অন্তরে
পুরোপুরি তওবা করেনি। কেউবা শিরককে ঘৃণা করতে পারেনি। কেউ বা মনে মনে ঘৃণা
করলেও বাহ্যিকভাবে মেনে নিয়েছিল এবং বাধা দেওয়ার কোন চেষ্টা করেনি।
আল্লাহ যখন তূর পাহাড় তুলে ধরে ভয় দেখিয়ে তাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি নেন,
তখনও তাদের কেউ কেউ (পরবর্তীতে) বলেছিল, سَمِعْنَا وَعَصَيْنَا ‘আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম’ (বাক্বারাহ ২/৯৩)।
যদিও অমান্য করলাম কথাটি ছিল পরের এবং তা প্রমাণিত হয়েছিল তাদের বাস্তব
ক্রিয়াকর্মে। যেমন আল্লাহ এইসব প্রতিশ্রুতি দানকারীদের পরবর্তী আচরণ
সম্বন্ধে বলেন,
ثُمَّ
تَوَلَّيْتُم مِّن بَعْدِ ذَلِكَ فَلَوْلاَ فَضْلُ اللهِ عَلَيْكُمْ
وَرَحْمَتُهُ لَكُنتُم مِنَ الْخَاسِرِينَ- (البقرة ৬৪)-
‘অতঃপর তোমরা উক্ত ঘটনার পরে (তোমাদের প্রতিশ্রুতি
থেকে) ফিরে গেছ। যদি আল্লাহর বিশেষ করুণা ও অনুগ্রহ তোমাদের উপরে না থাকত,
তাহ’লে অবশ্যই তোমরা ধ্বংস হয়ে যেতে’ (বাক্বারাহ ২/৬৪)।
সম্প্রদায়ের লোকদের শাস্তি দানের পর মূসা (আঃ) এবার
সামেরীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে সামেরী! তোমার ব্যাপার কি?’ ‘সে বলল, আমি
দেখলাম, যা অন্যেরা দেখেনি। অতঃপর আমি সেই প্রেরিত ব্যক্তির (অর্থাৎ
জিব্রীলের) পদচিহ্নের নীচ থেকে এক মুষ্টি মাটি নিয়ে নিলাম। অতঃপর আমি তা
(আগুনে গলিত অলংকারের অবয়বের প্রতি) নিক্ষেপ করলাম। আমার মন এটা করতে
প্ররোচিত করেছিল (অর্থাৎ কারু পরামর্শে নয় বরং নিজস্ব চিন্তায় ও শয়তানী
কুমন্ত্রণায় আমি একাজ করেছি)’। ‘মূসা বললেন, দূর হ, তোর জন্য সারা জীবন এই
শাস্তিই রইল যে, তুই বলবি, ‘আমাকে কেউ স্পর্শ করো না’ এবং তোর জন্য
(আখেরাতে) একটা নির্দিষ্ট ওয়াদা রয়েছে (অর্থাৎ জাহান্নাম), যার ব্যতিক্রম
হবে না। এক্ষণে তুই তোর সেই ইলাহের প্রতি লক্ষ্য কর, যাকে তুই সর্বদা পূজা
দিয়ে ঘিরে থাকতিস। আমরা ওটাকে (অর্থাৎ কৃত্রিম গো-বৎসটাকে) অবশ্যই
জ্বালিয়ে দেব এবং অবশ্যই ওকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে ছিটিয়ে দেব’ (ত্বোয়াহা ৯৫-৯৭)।
পারস্য অথবা ভারতবর্ষের অধিবাসী সামেরী গো-পূজারী
সম্প্রদায়ের লোক ছিল। পরে মিসরে পৌঁছে সে মূসা (আঃ)-এর উপরে বিশ্বাস
স্থাপন করে। অত্যন্ত চতুর এই ব্যক্তিটি পরে কপট বিশ্বাসী ও মুনাফিক হয়ে
যায়। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না পাওয়ায় সে বনু ইস্রাঈলদের সাথে সাগর পার
হওয়ার সুযোগ পায়। মূসা (আঃ)-এর বিপুল নাম-যশ ও অলৌকিক ক্ষমতায় সে তার
প্রতি মনে মনে ঈর্ষা পরায়ণ ছিল। মূসার সান্নিধ্য ও নিজস্ব সুক্ষ্মদর্শিতার
কারণে সে জিব্রাঈল ফেরেশতা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সেই আগ্রহের কারণেই
সাগর পার হওয়ার সময় সে জিব্রীলকে চিনতে পারে ও তার ঘোড়ার পদচিহ্নের মাটি
সংগ্রহ করে। তার ধারণা ছিল যে, মূসার যাবতীয় ক্ষমতার উৎস হ’ল এই ফেরেশতা।
অতএব তার স্পর্শিত মাটি দিয়ে সেও এখন মূসার ন্যায় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী
হবে।
মূসা (আঃ) সামেরীর জন্য পার্থিব জীবনে এই শাস্তি
নির্ধারণ করেন যে, সবাই তাকে বর্জন করবে এবং কেউ তার কাছে ঘেঁষবে না। তিনি
তাকেও নির্দেশ দেন যে, সে কারও গায়ে হাত লাগাবে না। সারা জীবন এভাবেই সে
বন্য জন্তুর ন্যায় সবার কাছ থেকে আলাদা থাকবে। এটাও সম্ভবপর যে, পার্থিব
আইনগত শাস্তির ঊর্ধ্বে খোদ তার সত্তায় আল্লাহর হুকুমে এমন বিষয় সৃষ্টি
হয়েছিল, যদ্দরুন সে নিজেও অন্যকে স্পর্শ করতে পারত না এবং অন্যেরাও তাকে
স্পর্শ করতে পারত না। যেমন এক বর্ণনায় এসেছে যে, মূসা (আঃ)-এর বদদো‘আয় তার
মধ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, সে কাউকে হাত লাগালে বা কেউ তাকে
হাত লাগালে উভয়েই জ্বরাক্রান্ত হয়ে যেত’ (কুরতুবী, ত্বোয়াহা ৯৫)। এই ভয়ে সে সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে উদ্ভ্রান্তের মত ঘোরাফেরা করত। কাউকে নিকটে আসতে দেখলেই সে চীৎকার করে বলে উঠতো لامِسَاسَ
‘আমাকে কেউ স্পর্শ করো না’। বস্ত্ততঃ মৃত্যুদন্ডের চাইতে এটিই ছিল কঠিন
শাস্তি। যা দেখে অপরের শিক্ষা হয়। বলা বাহুল্য, আজও ভারতবর্ষের হিন্দুদের
মধ্যে গো-মাতার পূজা অব্যাহত রয়েছে। যদিও উদারমনা উচ্চ শিক্ষিত হিন্দুগণ
ক্রমেই এ অলীক বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসছেন এবং গাভীকে দেবী নয় বরং মানুষের
ব্যবহারযোগ্য ও খাদ্যযোগ্য প্রাণী হিসাবে বিশ্বাস করেন।
কুরতুবী বলেন, এর মধ্যে দলীল রয়েছে এ বিষয়ে যে,
বিদ‘আতী ও পাপাচারী ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা যরূরী। তাদের সঙ্গে কোনরূপ
মেলামেশা ও আদান-প্রদান না করাই কর্তব্য। যেমন আচরণ শেষনবী (ছাঃ) জিহাদ
থেকে পিছু হটা মদীনার তিনজন ধনীলোকের সাথে (তাদের তওবা কবুলের আগ পর্যন্ত)
করেছিলেন (কুরতুবী)।
মূসা (আঃ) তূর পাহাড়ে তওরাৎ প্রাপ্ত হয়ে বনু
ইস্রাঈলের কাছে ফিরে এসে তা পেশ করলেন এবং বললেন যে, এটা আল্লাহ প্রদত্ত
কিতাব। তোমরা এর অনুসরণ কর। তখন কিছু সংখ্যক উদ্ধত লোক বলে উঠলো, যদি
আল্লাহ স্বয়ং আমাদের বলে দেন যে, এটি তাঁর প্রদত্ত কিতাব, তাহ’লেই কেবল
আমরা বিশ্বাস করব, নইলে নয়। হতে পারে তুমি সেখানে চল্লিশ দিন বসে বসে এটা
নিজে লিখে এনেছ। তখন মূসা (আঃ) আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে তাঁর সাথে তূর
পাহাড়ে যেতে বললেন। বনু ইস্রাঈলরা তাদের মধ্যে বাছাই করা সত্তর জনকে
মনোনীত করে মূসা (আঃ)-এর সাথে তূর পাহাড়ে প্রেরণ করল। সেখানে পৌঁছে তারা
আল্লাহর বাণী স্বকর্ণে শুনতে পেল। এরপরেও তাদের অবাধ্য মন শান্ত হ’ল না।
শয়তানী ধোঁকায় পড়ে তারা নতুন এক অজুহাত তুলে বলল, এগুলো আল্লাহর কথা না
অন্য কারু কথা, আমরা বুঝবো কিভাবে? অতএব যতক্ষণ আমরা তাঁকে সশরীরে
প্রকাশ্যে আমাদের সম্মুখে না দেখব, ততক্ষণ আমরা বিশ্বাস করব না যে, এসব
আল্লাহর বাণী। কিন্তু যেহেতু এ পার্থিব জগতে চর্মচক্ষুতে আল্লাহকে দেখার
ক্ষমতা কারু নেই, তাই তাদের এই চরম ধৃষ্টতার জবাবে আসমান থেকে ভীষণ এক
নিনাদ এল, যাতে সব নেতাগুলোই চোখের পলকে অক্কা পেল।
অকস্মাৎ এমন ঘটনায় মূসা (আঃ) বিস্মিত ও ভীত-বিহবল
হয়ে পড়লেন। তিনি প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! এমনিতেই ওরা হঠকারী।
এরপরে এদের এই মৃত্যুতে লোকেরা আমাকেই দায়ী করবে। কেননা মূল ঘটনার সাক্ষী
কেউ থাকল না আমি ছাড়া। অতএব হে আল্লাহ! ওদেরকে পুনর্জীবন দান কর। যাতে আমি
দায়মুক্ত হ’তে পারি এবং ওরাও গিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে। আল্লাহ মূসার দো‘আ
কবুল করলেন এবং ওদের জীবিত করলেন। এ ঘটনা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে-
وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوسَى لَن نُّؤْمِنَ
لَكَ حَتَّى نَرَى اللهَ جَهْرَةً فَأَخَذَتْكُمُ الصَّاعِقَةُ
وَأَنتُمْ تَنظُرُونَ- ثُمَّ بَعَثْنَاكُم مِّن بَعْدِ مَوْتِكُمْ
لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ- (البقرة ৫৫-৫৬)-
‘আর যখন তোমরা বললে, হে মূসা! কখনোই আমরা তোমাকে
বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখতে পাব। তখন
তোমাদেরকে পাকড়াও করল এক ভীষণ নিনাদ (বজ্রপাত), যা তোমাদের চোখের সামনেই
ঘটেছিল’। ‘অতঃপর তোমাদের মৃত্যুর পর আমরা তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করলাম,
যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর’ (বাক্বারাহ ২/৫৫-৫৬)।
সাগরডুবি থেকে মুক্তি পাবার পর হ’তে সিনাই উপত্যকা
পেরিয়ে তূর পাহাড়ে পৌঁছা পর্যন্ত সময়কালে মূর্তিপূজার আবদার, গো-বৎস পূজা ও
তার শাস্তি, তওরাৎ লাভ ও তা মানতে অস্বীকার এবং তূর পাহাড় উঠিয়ে ভয়
প্রদর্শন, আল্লাহ্কে স্বচক্ষে দেখার যিদ ও তার পরিণতি প্রভৃতি ঘটনা সমূহের
পর এবার তাদের মূল গন্তব্যে যাত্রার জন্য আদেশ করা হ’ল।
অবাধ্য জাতিকে তাদের আদি বাসস্থানে রওয়ানার
প্রাক্কালে মূসা (আঃ) তাদেরকে দূরদর্শিতাপূর্ণ উপদেশবাণী শুনান এবং যেকোন
বাধা সাহসের সাথে অতিক্রম করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। সাথে সাথে তিনি
তাদেরকে বিগত দিনে আল্লাহর অলৌকিক সাহায্য লাভের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে
অভয়বাণী শুনান। যেমন আল্লাহর ভাষায়,
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا
قَوْمِ اذْكُرُوْا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَعَلَ فِيْكُمْ
أَنبِيَاءَ وَجَعَلَكُمْ مُلُوْكاً وَآتَاكُمْ مَّا لَمْ يُؤْتِ أَحَداً
مِّنَ الْعَالَمِيْنَ- يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ
الَّتِيْ كَتَبَ اللهُ لَكُمْ وَلاَ تَرْتَدُّوْا عَلَى أَدْبَارِكُمْ
فَتَنْقَلِبُوْا خَاسِرِيْنَ- (المائدة ২০-২১)-
‘আর যখন মূসা স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার
সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহরাজি স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের
মধ্যে নবীগণকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে রাজ্যাধিপতি বানিয়েছেন এবং
তোমাদেরকে এমন সব বস্ত্ত দিয়েছেন, যা বিশ্বজগতের কাউকে দেননি’। ‘হে আমার
সম্প্রদায়! পবিত্র ভূমিতে (বায়তুল মুক্বাদ্দাস শহরে) প্রবেশ কর, যা আল্লাহ
তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আর তোমরা পশ্চাদদিকে প্রত্যাবর্তন
করবে না। তাতে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (মায়েদাহ ৫/২০-২১)।
বিভিন্ন রেওয়ায়াত অনুযায়ী বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ
সমগ্র শাম অর্থাৎ সিরিয়া অঞ্চল পবিত্র ভূমির অন্তর্গত। আমাদের রাসূল (ছাঃ)
কর্তৃক শাম পবিত্র ভূমি হওয়ার বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে।[41]
আবহাওয়াগত দিক দিয়ে সিরিয়া প্রাচীন কাল থেকেই শস্য-শ্যামল এবং
ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ এলাকা হিসাবে খ্যাত। জাহেলী যুগে মক্কার ব্যবসায়ীগণ
নিয়মিত ভাবে ইয়ামন ও সিরিয়ায় যথাক্রমে শীতকালে ও গ্রীষ্মকালে ব্যবসায়িক
সফরে অভ্যস্ত ছিল। বলা চলে যে, এই দু’টি সফরের উপরেই মক্কাবাসীদের জীবিকা
নির্ভর করত। সূরা কুরায়েশ-য়ে এ বিষয়ে উল্লেখিত হয়েছে।
আল্লাহ সূরা বনু ইস্রাঈলের ১ম আয়াতে এই এলাকাকে بَارَكْنَا حَوْلَهُ
বা ‘বরকতময় এলাকা’ বলে অভিহিত করেছেন। এর বরকত সমূহ ছিল দ্বিবিধ: ধর্মীয় ও
পার্থিব। ধর্মীয় দিকে বরকতের কারণ ছিল এই যে, এ অঞ্চলটি হ’ল, ইবরাহীম,
ইয়াকূব, দাঊদ, সুলায়মান, ঈসা (আঃ) সহ কয়েক হাযার নবীর জন্মস্থান,
বাসস্থান, কর্মস্থল ও মৃত্যুস্থান। মূসা (আঃ)-এর জন্ম মিসরে হ’লেও তাঁর
মৃত্যু হয় এখানে এবং তাঁর কবর হ’ল বায়তুল মুক্কাদ্দাসের উপকণ্ঠে।
নিকটবর্তী তীহ্ প্রান্তরে মূসা, হারূণ, ইউশা‘ প্রমুখ নবী বহু বৎসর ধরে
তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন। তাঁদের প্রচারের ফল অন্ততঃ এটুকু ছিল
এবং এখনও আছে যে, আরব উপদ্বীপে কোন নাস্তিক বা কাফির নেই।
অতঃপর পার্থিব বরকত এই যে, সিরিয়া অঞ্চল ছিল চিরকাল
উর্বর এলাকা। এখানে রয়েছে অসংখ্য ঝরণা, বহমান নদ-নদী এবং অসংখ্য ফল-ফসলের
বাগ-বাগিচা সমূহ। বিভিন্ন সুমিষ্ট ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলটি সমগ্র
মধ্যপ্রাচ্যে বলা যায় অতুলনীয়। একটি হাদীছে এসেছে, দাজ্জাল সমগ্র পৃথিবীতে
বিচরণ করবে কিন্তু চারটি মসজিদে পৌঁছতে পারবে না; বায়তুল্লাহ, মসজিদে
নববী, বায়তুল মুক্বাদ্দাস ও মসজিদে তূর’।[42]
মূসা (আঃ)-এর আগমনকালে বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ সমগ্র
শাম এলাকা আমালেক্বা সম্প্রদায়ের অধীনস্থ ছিল। তারা ছিল কওমে ‘আদ-এর একটি
শাখা গোত্র। দৈহিক দিক দিয়ে তারা ছিল অত্যন্ত সুঠাম, বলিষ্ঠ ও ভয়াবহ আকৃতি
বিশিষ্ট। তাদের সাথে যুদ্ধ করে বায়তুল মুক্বাদ্দাস অধিকার করার নির্দেশ
মূসা (আঃ) ও তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ দিয়েছিলেন। হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর
মিসরে হিজরতের পর কেন‘আন সহ শাম এলাকা আমালেক্বাদের অধীনস্থ হয়। আয়াতে
বর্ণিত ‘রাজ্যাধিপতি বানিয়েছেন’ বাক্যটি ভবিষ্যদ্বাণী হ’তে পারে, যার
সম্পর্কে মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট থেকে নিশ্চিত ওয়াদা পেয়েছিলেন। তবে শর্ত
ছিল যে, তারা জিহাদ করে কেন‘আন দখল করবে। অর্থাৎ আল্লাহর উপরে ভরসা করে
জিহাদে অগ্রসর হ’লে তারা অবশ্যই জয়লাভ করবে। যেভাবে ফেরাঊনের বিরুদ্ধে
তারা অলৌকিক বিজয় অর্জন করেছিল মাত্র কিছুদিন পূর্বে।
অতঃপর ‘তাদেরকে এমন সব বস্ত্ত দেওয়া হয়েছে, যা
বিশ্বের কাউকে দেওয়া হয়নি’ বলতে তাদের দেওয়া ধর্মীয় নেতৃত্ব ও সামাজিক
নেতৃত্ব উভয়কে বুঝানো হয়েছে, যা একত্রে কাউকে ইতিপূর্বে দেওয়া হয়নি। এটাও
ভবিষ্যদ্বাণী হ’তে পারে, যা তাদের বংশের পরবর্তী নবী দাঊদ ও সুলায়মানের
সময়ে পূর্ণতা লাভ করেছিল। তাদের সময়েও এটা সম্ভব ছিল, যদি নাকি তারা নবী
মূসা (আঃ)-এর নেতৃত্বে জিহাদে বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু হতভাগারা তা পারেনি বলেই
বঞ্চিত হয়েছিল।
আল্লাহ পাক মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে বনু ইস্রাঈলকে
আমালেক্বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাম দখল করতে বলেছিলেন। সাথে
সাথে এ সুসংবাদও দিয়েছিলেন যে, শামের ভূখন্ড তাদের ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে (মায়েদাহ ৫/২১)। কাজেই তোমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু এইসব বিলাসী কাপুরুষেরা আল্লাহর কথায় দৃঢ় বিশ্বাস আনতে পারেনি।
মূসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য বনী
ইস্রাঈলকে সাথে নিয়ে মিসর থেকে শাম অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। যথা সময়ে তাঁরা
জর্দান নদী পার হয়ে ‘আরীহা’ (أريحة)
পৌঁছে শিবির স্থাপন করলেন। এটি ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম মহানগরী সমূহের
অন্যতম, যা জর্দান নদী ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত।
যা আজও স্বনামে বিদ্যমান রয়েছে। মূসা (আঃ)-এর সময়ে এ শহরের অত্যাশ্চর্য
জাঁক-জমক ও বিস্তৃতি ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে।
শিবির স্থাপনের পর মূসা (আঃ) বিপক্ষ দলের অবস্থা ও
অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য ১২ জন সর্দারকে প্রেরণ করলেন। যারা ছিলেন হযরত
ইয়াকূব (আঃ)-এর বারো পুত্রের বংশধরগণের ‘বারোজন প্রতিনিধি, যাদেরকে তিনি
আগেই নির্বাচন করেছিলেন স্ব স্ব গোত্রের লোকদের দেখাশুনার জন্য’ (মায়েদাহ ৫/১২)।
তারা রওয়ানা হবার পর বায়তুল মুক্বাদ্দাস শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছলে বিপক্ষ
দলের বিশালদেহী বিকট চেহারার একজন লোকের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। ইস্রাঈলী
রেওয়ায়াত সমূহে লোকটির নাম ‘আউজ ইবনে ওনুক’ (عوج بن عنق) বলা হয়েছে এবং তার আকার-আকৃতি ও শক্তি-সাহসের অতিরঞ্জিত বর্ণনা সমূহ উদ্ধৃত হয়েছে (ইবনু কাছীর)।
যাই হোক উক্ত ব্যক্তি একাই বনু ইস্রাঈলের এই বার জন সরদারকে পাকড়াও করে
তাদের বাদশাহর কাছে নিয়ে গেল এবং অভিযোগ করল যে, এই লোকগুলি আমাদের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতলব নিয়ে এসেছে। বাদশাহ তার নিকটতম লোকদের সাথে
পরামর্শের পর এদের ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন এই উদ্দেশ্যে যে, এরা গিয়ে
তাদের নেতাকে আমালেক্বাদের জাঁক-জমক ও শৌর্য-বীর্যের স্বচক্ষে দেখা কাহিনী
বর্ণনা করবে। তাতে ওরা ভয়ে এমনিতেই পিছিয়ে যাবে। পরবর্তীতে দেখা গেল যে,
বাদশাহর ধারণাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। এই ভীত-কাপুরুষ সর্দাররা জিহাদ দূরে
থাক, ওদিকে তাকানোর হিম্মতও হারিয়ে ফেলেছিল।
বনু ইস্রাঈলের বারো জন সর্দার আমালেক্বাদের হাত থেকে
মুক্ত হয়ে স্বজাতির কাছে ফিরে এল এবং আমালেক্বাদের বিস্ময়কর উন্নতি ও
অবিশ্বাস্য শক্তি-সামর্থ্যের কথা মূসা (আঃ)-এর নিকটে বর্ণনা করল। কিন্তু
মূসা (আঃ) এতে মোটেই ভীত হননি। কারণ তিনি আগেই অহী প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং
বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। সেমতে তিনি গোত্রনেতাদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি
গ্রহণের নির্দেশ দিলেন এবং আমালেক্বাদের শৌর্য-বীর্যের কথা অন্যের কাছে
প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু দেখা গেল যে, ইউশা‘ বিন নূন ও কালেব বিন
ইউক্বেন্না ব্যতীত বাকী সর্দাররা গোপনে সব ফাঁস করে দিল (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। ফলে যা হবার তাই হ’ল। এই ভীতু আরামপ্রিয় জাতি একেবারে বেঁকে বসলো।
قَالُوا يَا مُوسَى إِنَّ فِيهَا قَوْماً
جَبَّارِيْنَ وَإِنَّا لَنْ نَدْخُلَهَا حَتَّى يَخْرُجُوا مِنْهَا فَإِن
يَّخْرُجُوا مِنْهَا فَإِنَّا دَاخِلُونَ- (المائدة ২২)-
‘তারা
বলল, হে মূসা! সেখানে একটি প্রবল পরাক্রান্ত জাতি রয়েছে। আমরা কখনো
সেখানে যাব না, যে পর্যন্ত না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। যদি তারা সেখান
থেকে বের হয়ে যায়, তবে নিশ্চিতই আমরা সেখানে প্রবেশ করব’ (মায়েদাহ ৫/২২)।
অর্থাৎ ওরা চায় যে, মূসা (আঃ) তার মু‘জেযার মাধ্যমে যেভাবে ফেরাঊনকে
ডুবিয়ে মেরে আমাদের উদ্ধার করে এনেছেন, অনুরূপভাবে আমালেক্বাদের তাড়িয়ে
দিয়ে তাদের পরিত্যক্ত অট্টালিকা ও সম্পদরাজির উপরে আমাদের মালিক বানিয়ে
দিন। অথচ আল্লাহর বিধান এই যে, বান্দাকে চেষ্টা করতে হবে এবং আল্লাহর উপর
ভরসা করতে হবে। কিন্তু বনু ইস্রাঈলরা এক পাও বাড়াতে রাযী হয়নি। এমতাবস্থায়
قَالَ رَجُلاَنِ مِنَ الَّذِيْنَ
يَخَافُوْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمَا ادْخُلُوْا عَلَيْهِمُ الْبَابَ
فَإِذَا دَخَلْتُمُوْهُ فَإِنَّكُمْ غَالِبُوْنَ وَعَلَى اللهِ
فَتَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُم مُّؤْمِنِيْنَ- (المائدة ২৩)-
‘তাদের মধ্যকার দু’জন আল্লাহভীরু ব্যক্তি (সম্ভবতঃ
পূর্বের দু’জন সর্দার হবেন, যাদের মধ্যে ইউশা‘ পরে নবী হয়েছিলেন), যাদের
প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন, তারা বলল, (মূসা (আঃ)-এর আদেশ মতে) ‘তোমরা
ওদের উপর আক্রমণ করে (শহরের মূল) দরজায় প্রবেশ কর। (কেননা আমাদের নিশ্চিত
বিশ্বাস যে,) যখনই তোমরা তাতে প্রবেশ করবে, তখনই তোমরা অবশ্যই জয়ী হবে।
আর তোমরা আল্লাহর উপরে ভরসা কর, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (মায়েদাহ ৫/২৩)।
কিন্তু ঐ দুই নেককার সর্দারের কথার প্রতি তারা দৃকপাত
করল না। বরং আরও উত্তেজিত হয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মূসা (আঃ)-কে উদ্দেশ্য
করে বলল,يَا مُوسَى إِنَّا لَنْ نَدْخُلَهَا أَبَداً
مَا دَامُوْا فِيهَا، فَاذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلا، إِنَّا
هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ- (المائدة ২৪)-
‘হে মূসা! আমরা কখনোই সেখানে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ তারা সেখানে আছে।
অতএব তুমি ও তোমার পালনকর্তা যাও এবং যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানেই বসে রইলাম’
(মায়েদাহ ৫/২৪)। নবীর অবাধ্যতার ফলস্বরূপ এই জাতিকে ৪০ বছর তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত কারাগারে বন্দী থাকতে হয় (মায়েদাহ ৫/২৬)।
অতঃপর এইসব দুষ্টমতি নেতাদের মৃত্যুর পর পরবর্তী বংশধররা হযরত ইউশা‘ বিন
নূন (আঃ)-এর নেতৃত্বে জিহাদ করে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পুনর্দখল করে (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
বনু ইস্রাঈলের এই চূড়ান্ত বেআদবী ছিল কুফরীর নামান্তর
এবং অত্যন্ত পীড়াদায়ক। যা পরবর্তীতে প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়ে গেছে। বদরের
যুদ্ধের সময়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) কিছুটা অনুরূপ অবস্থায় পতিত
হয়েছিলেন। অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা ও ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর অল্প সংখ্যক
সবেমাত্র মুহাজির মুসলমানের মোকাবেলায় তিনগুণ শক্তিসম্পন্ন সুসজ্জিত বিরাট
কুরায়েশ সেনাবাহিনীর আগমনে হতচকিত ও অপ্রস্ত্তত মুসলমানদের বিজয়ের জন্য
যখন নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন, তখন
মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ আনছারী (রাঃ) দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, হে
আল্লাহর রাসূল! আমরা কস্মিনকালেও ঐকথা বলব না, যা মূসা (আঃ)-এর স্বজাতি
তাঁকে বলেছিল, فَاذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ- ‘তুমি ও তোমার প্রভু যাও যুদ্ধ করগে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)।
বরং আমরা আপনার ডাইনে, বামে, সামনে ও পিছনে থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত
করব। আপনি নিশ্চিন্তে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করুন’। বিপদ মুহূর্তে
সাথীদের এরূপ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত প্রীত
হয়েছিলেন।[43]
ইউসুফ হ’তে মূসা পর্যন্ত দীর্ঘ চার/পাঁচশ’ বছর মিসরে
অবস্থানের পর এবং নিজেদের বিরাট জনসংখ্যা ছাড়াও ফেরাঊনীদের বহু সংখ্যক লোক
গোপনে অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এবং মূসা (আঃ)-এর মত শক্তিশালী একজন নবীকে
পাওয়া সত্ত্বেও বনু ইস্রাঈলকে কেন রাতের অন্ধকারে মিসর থেকে পালিয়ে আসতে
হ’ল? অতঃপর পৃথিবীর কোথাও তারা আর স্থায়ীভাবে একত্রে বসবাস করতে পারেনি,
তার একমাত্র কারণ ছিল ‘জিহাদ বিমুখতা’। এই বিলাসী, ভীরু ও কাপুরুষের দল
‘ফেরাঊন ও তার দলবলের ভয়ে এতই ভীত ছিল যে, তাদের নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের
বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করত না। বরং মূসা (আঃ)-এর কাছে পাল্টা অভিযোগ তুলতো
যে, তোমার কারণেই আমরা বিপদে পড়ে গেছি’। যেমন সূরা আ‘রাফ ১২৯ আয়াতে এ
বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ‘অথচ ঐ সময় মিসরে মুসলমানের সংখ্যা মোট
জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ শতাংশ ছিল’।[44]
মিসর থেকে বেরিয়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাস নগরী দখলের
জন্যও তাদেরকে যখন জিহাদের হুকুম দেওয়া হ’ল, তখনও তারা একইভাবে পিছুটান
দিল। যার পরিণতি তারা সেদিনের ন্যায় আজও ভোগ করছে। বস্ত্ততঃ বিলাসী জাতি
ভীরু হয় এবং জিহাদ বিমুখ জাতি কখনোই কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।
মূসা (আঃ)-এর জীবনের এই শেষ পরীক্ষায় দৃশ্যত: তিনি
ব্যর্থ হয়েছিলেন বলে অনুমিত হ’লেও প্রকৃত অর্থে তিনি ব্যর্থ হননি। বরং
তিনি সকল যুগের ঈমানদারগণকে জানিয়ে গেছেন যে, কেবল মু‘জেযা বা কারামত দিয়ে
দ্বীন বিজয়ী হয় না। তার জন্য প্রয়োজন আল্লাহর উপরে দৃঢ় বিশ্বাসী একদল
মুমিনের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা। আর এটাই হ’ল জিহাদ। ৪০ বছর পর যখন তারা পুনরায়
জিহাদে নামল, তখনই তারা বিজয়ী হ’ল। যুগে যুগে এটাই সত্য হয়েছে।
ফিলিস্তীন দখলকারী ‘জাববারীন’ তথা আমালেক্বা
সম্প্রদায়ের শক্তিশালী নেতারা মূসা (আঃ) প্রেরিত ১২ জন প্রতিনিধিকে ফেরৎ
পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। কারণ তারা মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযার কারণে
ফেরাঊনের সসৈন্যে সাগরডুবির খবর আগেই জেনেছিল। অতএব মূসা (আঃ)-এর বায়তুল
মুক্বাদ্দাস অভিযান বন্ধ করার জন্য তারা বাঁকা পথ তালাশ করল। তারা অত্যন্ত
গোপনে বনু ইস্রাঈলের ঐ সময়কার একজন নামকরা সাধক ও দরবেশ আলেম বাল‘আম ইবনে
বা‘ঊরার (بلعم بن باعوراء)
কাছে বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদিসহ লোক পাঠাল। বাল‘আম তার স্ত্রীর অনুরোধে তা
গ্রহণ করল। অতঃপর তার নিকটে আসল কথা পাড়া হ’ল যে, কিভাবে আমরা মূসার
অভিযান ঠেকাতে পারি। আপনি পথ বাৎলে দিলে আমরা আরও মহামূল্যবান উপঢৌকনাদি
আপনাকে প্রদান করব। বাল‘আম উঁচুদরের আলেম ছিল। যে সম্পর্কে তার নাম না
নিয়েই আল্লাহ বলেন,
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي
آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ
فَكَانَ مِنَ الْغَاوِيْنَ- (الأعراف ১৭৫)-
‘আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন সেই লোকটির অবস্থা, যাকে
আমরা আমাদের নিদর্শন সমূহ দান করেছিলাম। অথচ সে তা পরিত্যাগ করে বেরিয়ে
গেল। আর তার পিছনে লাগল শয়তান। ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’ (আ‘রাফ ৭/১৭৫)।
কথিত আছে যে, বাল‘আম ‘ইসমে আযম’ জানত। সে যা দো‘আ
করত, তা সাথে সাথে কবুল হয়ে যেত। আমালেক্বাদের অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে সে
অবশেষে মূসার বিরুদ্ধে দো‘আ করল। কিন্তু তার জিহবা দিয়ে উল্টা দো‘আ বের
হ’তে লাগল যা আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যেতে লাগল। তখন সে দো‘আ বন্ধ করল।
কিন্তু অন্য এক পৈশাচিক রাস্তা সে তাদের বাৎলে দিল। সে বলল, বনু
ইস্রাঈলগণের মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে দিতে পারলে আল্লাহ তাদের উপরে নারায
হবেন এবং তাতে মূসার অভিযান বন্ধ হয়ে যাবে’। আমালেক্বারা তার পরামর্শ
গ্রহণ করল এবং তাদের সুন্দরী মেয়েদেরকে বনু ইস্রাঈলের নেতাদের সেবাদাসী
হিসাবে অতি গোপনে পাঠিয়ে দিল। বড় একজন নেতা এফাঁদে পা দিল। আস্তে আস্তে তা
অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হ’ল। ফলে আল্লাহর গযব নেমে এল। বনু ইস্রাঈলীদের
মধ্যে প্লেগ মহামারী দেখা দিল। কথিত আছে যে, একদিনেই সত্তর হাযার লোক মারা
গেল। এ ঘটনায় বাকী সবাই তওবা করল এবং প্রথম পথভ্রষ্ট নেতাকে প্রকাশ্যে
হত্যা করে রাস্তার উপরে ঝুলিয়ে রাখা হ’ল। অতঃপর আল্লাহর গযব উঠে গেল। এগুলি
ইস্রাঈলী বর্ণনা।=(কুরতুবী ও ইবনু কাছীর উভয়ে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন
উক্ত আয়াতের শানে নুযূল হিসাবে। আয়াতের মর্মে বুঝা যায় যে, ঘটনার কিছু
সারবত্তা রয়েছে। যদিও সত্য বা মিথ্যা আল্লাহই ভালো জানেন। - লেখক)।
সম্ভবতঃ সম্প্রদায়ের নেতাদের ক্রমাগত অবাধ্যতা, শঠতা
ও পাপাচারে অতিষ্ঠ হ’য়ে এবং একসাথে এই বিরাট জনশক্তি বিনষ্ট হওয়ায় মূসা
(আঃ) বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযানের সংকল্প পরিত্যাগ করেন।
মূসা (আঃ)-এর প্রতি অবাধ্যতা ও জিহাদ থেকে বিমুখ
হওয়ার শাস্তি স্বরূপ বনু ইস্রাঈলগণকে মিসর ও শাম-এর মধ্যবর্তী একটি
উন্মুক্ত প্রান্তরে দীর্ঘ ৪০ বছরের জন্য বন্দী করা হয়। তাদের অবাধ্যতায়
বিরক্ত ও হতাশ হয়ে নবী মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন,
قَالَ رَبِّ إِنِّي لا أَمْلِكُ إِلاَّ نَفْسِي وَأَخِيْ فَافْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ- (المائدة ২৫)-
‘হে
আমার পালনকর্তা! আমি কোন ক্ষমতা রাখি না কেবল আমার নিজের উপর ও আমার
ভাইয়ের উপর ব্যতীত। অতএব আপনি আমাদের ও পাপাচারী কওমের মধ্যে ফায়ছালা করে
দিন’ (মায়েদাহ ৫/২৫)। জবাবে আল্লাহ বলেন,
قَالَ فَإِنَّهَا
مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً يَّتِيْهُوْنَ فِي الأَرْضِ
فَلاَ تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ- (المائدة ২৬)-
‘এদেশটি (বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ শামদেশ) চল্লিশ বছর
পর্যন্ত তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হ’ল। এ সময় তারা ভূপৃষ্ঠে উদ্ভ্রান্ত হয়ে
ফিরবে। অতএব তুমি অবাধ্য কওমের জন্য দুঃখ করো না’ (মায়েদাহ ৫/২৬)। تَاهَ يَتِيْهُ تِيْهًا অর্থ গর্ব করা, পথ হারিয়ে ঘোরা ইত্যাদি। এখান থেকেই উক্ত প্রান্তরের নাম হয়েছে ‘তীহ্’ (تِيْه)।
বস্ত্ততঃ এই উন্মুক্ত কারাগারে না ছিল কোন প্রাচীর, না ছিল কোন
কারারক্ষী। তারা প্রতিদিন সকালে উঠে মিসর অভিমুখে রওয়ানা হ’ত। আর সারাদিন
চলার পর রাতে আবার সেখানে এসেই উপস্থিত হ’ত, যেখান থেকে সকালে তারা রওয়ানা
হয়েছিল। কিন্তু কোনভাবেই তারা অদৃশ্য কারা প্রাচীর ভেদ করে যেতে পারত না।
এভাবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত হতবুদ্ধি অবস্থায় দিগ্বিদিক ঘুরে এই হঠকারী
অবাধ্য জাতি তাদের দুনিয়াবী শাস্তি ভোগ করতে থাকে। যেমন ইতিপূর্বে নূহ
(আঃ)-এর অবাধ্য কওম দুনিয়াবী শাস্তি হিসাবে প্লাবণে ডুবে নিশ্চিহ্ন
হয়েছিল। বস্ত্ততঃ চল্লিশ বছরের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে হারূণ ও মূসা (আঃ)-এর
তিন বছরের বিরতিতে মৃত্যু হয়। অতঃপর শাস্তির মেয়াদ শেষে পরবর্তী নবী ইউশা‘
বিন নূন-এর নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে তারা বায়তুল মুক্কাদ্দাস জয়ে সমর্থ
হয় এবং সেখানে প্রবেশ করে। বর্ণিত হয়েছে যে, ১২ জন নেতার মধ্যে ১০ জন
অবাধ্য ও ভীরু নেতা এরি মধ্যে মারা যায় এবং মূসার অনুগত ইউশা‘ ও কালেব দুই
নেতাই কেবল বেঁচে থাকেন, যাদের হাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজিত হয় (কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর মায়েদাহ ২৬)।
নবীর সঙ্গে যে বেআদবী তারা করেছিল, তাতে আল্লাহর
গযবে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আল্লাহ পাক হয়ত এ
জাতিকে আরও পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং আল্লাহর অপার অনুগ্রহপুষ্ট একটি
জাতি নিজেদের অবাধ্যতা ও হঠকারিতার ফলে কিভাবে আল্লাহর অভিসম্পাৎগ্রস্ত হয়
এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত চিরস্থায়ী লাঞ্ছনার শিকার হয়, পৃথিবীর মানুষের
নিকটে দৃষ্টান্ত হিসাবে তা পেশ করতে চেয়েছিলেন। ঠিক যেভাবে দৃষ্টান্ত
হয়েছে ফেরাঊন একজন অবাধ্য ও অহংকারী নরপতি হিসাবে। আর তাই বনু ইস্রাঈলের
পরীক্ষার মেয়াদ আরও বর্ধিত হ’ল। নিম্নে তাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কিছু
নিদর্শন বর্ণিত হ’ল।-
১. মেঘ দ্বারা ছায়া প্রদান :
ছায়াশূন্য তপ্ত বালুকা বিস্তৃত মরুভূমিতে কাঠফাটা
রোদে সবচেয়ে প্রয়োজন যেসব বস্ত্তর, তন্মধ্যে ‘ছায়া’ হ’ল সর্বপ্রধান।
হঠকারী উম্মতের অবাধ্যতায় ত্যক্ত-বিরক্ত মূসা (আঃ) দয়াপরবশ হয়ে আল্লাহর
নিকটে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রার্থনা নিবেদন করেছেন। দয়ালু আল্লাহ তাঁর
দো‘আ সমূহ কবুল করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাঁর বিশেষ রহমত সমূহ
নাযিল করেছেন। তন্মধ্যে একটি হ’ল উন্মুক্ত তীহ্ প্রান্তরের উপরে শামিয়ানা
সদৃশ মেঘমালার মাধ্যমে শান্তিদায়ক ছায়া প্রদান করা। যেমন আল্লাহ এই
অকৃতজ্ঞ জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, وَظَلَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْغَمَامَ ‘স্মরণ কর সে কথা, যখন আমরা তোমাদেরকে ছায়া দান করেছিলাম মেঘমালার মাধ্যমে’ (বাক্বারাহ ২/৫৭)।
২. ঝর্ণাধারার প্রবাহ :
ছায়ার পরেই গুরুত্বপূর্ণ বস্ত্ত হ’ল পানি। যার অপর
নাম জীবন। পানি বিহনে তৃষ্ণার্ত পিপাসার্ত উম্মতের আহাজারিতে দয়া বিগলিত
নবী মূসা স্বীয় প্রভুর নিকটে কাতর কণ্ঠে পানি প্রার্থনা করলেন। কুরআনের
ভাষায়,
وَإِذِ اسْتَسْقَى مُوْسَى لِقَوْمِهِ
فَقُلْنَا اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْحَجَرَ فَانْفَجَرَتْ مِنْهُ اثْنَتَا
عَشْرَةَ عَيْناً قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍ مَّشْرَبَهُمْ كُلُوْا
وَاشْرَبُوْا مِن رِّزْقِ اللهِ وَلاَ تَعْثَوْا فِي الأَرْضِ
مُفْسِدِيْنَ- (البقرة ৬০)-
‘আর মূসা যখন স্বীয় জাতির জন্য পানি চাইল, তখন আমি
বললাম, তোমার লাঠি দিয়ে পাথরের উপরে আঘাত কর। অতঃপর তা থেকে বেরিয়ে এলো
(১২টি গোত্রের জন্য) ১২টি ঝর্ণাধারা। তাদের সব গোত্রই চিনে নিল (অর্থাৎ
মূসার নির্দেশ অনুযায়ী নির্ধারণ করে নিল) নিজ নিজ ঘাট। (আমি বললাম,) তোমরা
আল্লাহর দেওয়া রিযিক খাও আর পান কর। খবরদার যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে
বেড়িয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/৬০)।
বস্ত্ততঃ ইহুদী জাতি তখন থেকে এযাবত পৃথিবী ব্যাপী ফাসাদ সৃষ্টি করেই চলেছে। তারা কখনোই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেনি।
৩. মান্না ও সালওয়া খাদ্য পরিবেশন :
মরুভূমির বুকে চাষবাসের সুযোগ নেই। নেই শস্য উৎপাদন ও
বাইরে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ। কয়েকদিনের মধ্যেই মওজুদ খাদ্য শেষ
হয়ে গেলে হাহাকার পড়ে গেল তাদের মধ্যে। নবী মূসা (আঃ) ফের দো‘আ করলেন
আল্লাহর কাছে। এবার তাদের জন্য আসমান থেকে নেমে এলো জান্নাতী খাদ্য
‘মান্না ও সালওয়া’- যা পৃথিবীর আর কোন নবীর উম্মতের ভাগ্যে জুটেছে বলে জানা
যায় না।
‘মান্না’ এক প্রকার খাদ্য, যা আল্লাহ তা‘আলা বনু
ইস্রাঈলদের জন্য আসমান থেকে অবতীর্ণ করতেন। আর তা ছিল দুধের চেয়েও সাদা
এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি। আর ‘সালওয়া’ হচ্ছে আসমান থেকে আগত এক প্রকার পাখি।[45] প্রথমটি দিয়ে রুটি ও দ্বিতীয়টি দিয়ে গোশতের অভাব মিটত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْكَمْأَةُ مِنَ الْمَنِّ ‘কামআহ হ’ল মান্ন-এর অন্তর্ভুক্ত’।[46]
এতে বুঝা যায় ‘মান্ন’ কয়েক প্রকারের ছিল। ইংরেজীতে ‘কামআহ’ অর্থ করা
হয়েছে ‘মাশরূম’ (Mashroom)। আধুনিক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মান্ন একপ্রকার
আঠা জাতীয় উপাদেয় খাদ্য। যা শুকিয়ে পিষে রুটি তৈরী করে তৃপ্তির সাথে আহার
করা যায়। ‘সালওয়া’ একপ্রকার চড়ুই পাখি, যা ঐসময় সিনাই এলাকায় প্রচুর পাওয়া
যেত। ব্যাঙের ছাতার মত সহজলভ্য ও কাই জাতীয় হওয়ায় সম্ভবত একে মাশরূম-এর
সাথে তুলনীয় মনে করা হয়েছে। তবে মাশরূম ও ব্যাঙের ছাতা সম্পূর্ণ পৃথক
জিনিস। কয়েক লাখ বনু ইস্রাঈল কয়েক বছর ধরে মান্না ও সালওয়া খেয়ে বেঁচে
ছিল। এতে বুঝা যায় যে, মান্ন ছিল চাউল বা গমের মত কার্বো-হাইড্রেট-এর উৎস
এবং সালওয়া বা চড়ুই জাতীয় পাখির গোশত ছিল ভিটামিন ও চর্বির উৎস। সব মিলে
তারা পরিপূর্ণ খাবার নিয়মিত খেয়ে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। দক্ষিণ
ইউরোপের সিসিলিতে, আরব উপদ্বীপের ইরাকে ও ইরানে, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতবর্ষে
মান্না জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়।[47]
অবাধ্য বনু ইস্রাঈলরা এগুলো সিরিয়ার তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছরের বন্দী জীবনে
বিপুলভাবে পেয়েছিল আল্লাহর বিশেষ রহমতে। ঈসার সাথী হাওয়ারীগণ এটা চেয়েছিল
(মায়েদাহ ৫/১১২-১১৫)। কিন্তু পেয়েছিল কি-না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
দুনিয়ায় বসেই জান্নাতের খাবার, এ এক অকল্পনীয়
অনির্বচনীয় আনন্দের বিষয়। কিন্তু এই হতভাগারা তাতেও খুব বেশীদিন খুশী
থাকতে পারেনি। তারা গম, তরকারি, ডাল-পেঁয়াজ ইত্যাদি খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে
উঠলো। যেমন আল্লাহ বলেন,
...
وَأَنْزَلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَى كُلُوْا مِنْ
طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَمَا ظَلَمُوْنَا وَلَـكِنْ كَانُوْا
أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُوْنَ- (البقرة ৫৭)-
‘... আমরা তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছি ‘মান্না’ ও
‘সালওয়া’। (আমরা বললাম) এসব পবিত্র বস্ত্ত তোমরা ভক্ষণ কর (কিন্তু ওরা
শুনল না, কিছু দিনের মধ্যেই তা বাদ দেওয়ার জন্য ও অন্যান্য নিম্নমানের
খাদ্য খাবার জন্য যিদ ধরলো)। বস্ত্ততঃ (এর ফলে) তারা আমার কোন ক্ষতি করতে
পারেনি, বরং নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছে’ (বাক্বারাহ ২/৫৭)।
আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,
وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوْسَى لَن
نَّصْبِرَ عَلَىَ طَعَامٍ وَاحِدٍ فَادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُخْرِجْ لَنَا
مِمَّا تُنْبِتُ الأَرْضُ مِنْ بَقْلِهَا وَقِثَّآئِهَا وَفُوْمِهَا
وَعَدَسِهَا وَبَصَلِهَا قَالَ أَتَسْتَبْدِلُوْنَ الَّذِيْ هُوَ أَدْنَى
بِالَّذِيْ هُوَ خَيْرٌ؟ إِهْبِطُوْا مِصْراً فَإِنَّ لَكُمْ مَّا
سَأَلْتُمْ وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ وَبَآؤُوْا
بِغَضَبٍ مِّنَ اللهِ، ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَانُوْا يَكْفُرُوْنَ
بِآيَاتِ اللهِ وَيَقْتُلُوْنَ النَّبِيِّيْنَ بِغَيْرِ الْحَقِّ ذَلِكَ
بِمَا عَصَوْا وَكَانُوْا يَعْتَدُوْنَ- (البقرة ৬১)-
‘যখন তোমরা বললে, হে মূসা! আমরা একই ধরনের খাদ্যের
উপরে কখনোই ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। কাজেই তুমি তোমার প্রভুর নিকটে
আমাদের পক্ষে প্রার্থনা কর তিনি যেন আমাদের জন্য এমন খাদ্য-শস্য দান করেন,
যা জমিতে উৎপন্ন হয়; যেমন তরি-তরকারি, কাকুড়, গম, রসুন, ডাল, পেঁয়াজ
ইত্যাদি। মূসা বললেন, তোমরা উত্তম খাদ্যের বদলে এমন খাদ্য পেতে চাও যা
নিম্নস্তরের? তাহ’লে তোমরা অন্য কোন শহরে চলে যাও। সেখানে তোমরা তোমাদের
চাহিদা মোতাবেক সবকিছু পাবে’ (বাক্বারাহ ২/৬১)।
৪. পার্শ্ববর্তী জনপদে যাওয়ার হুকুম ও আল্লাহর অবাধ্যতা :
বনু ইস্রাঈলগণ যখন জান্নাতী খাদ্য বাদ দিয়ে দুনিয়াবী
খাদ্য খাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যিদ ধরে বসলো, তখন আল্লাহ তাদের
পার্শ্ববর্তী জনপদে যেতে বললেন। যেখানে তাদের চাহিদামত খাদ্য-শস্যাদি তারা
সর্বদা প্রাপ্ত হবে। উক্ত জনপদে প্রবেশের সময় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার
জন্য তিনি কতগুলি আদব ও শিষ্টাচার মান্য করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা
তাতে কর্ণপাত করল না। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ قُلْنَا ادْخُلُوْا هَـذِهِ
الْقَرْيَةَ فَكُلُوْا مِنْهَا حَيْثُ شِئْتُمْ رَغَداً وَادْخُلُوا
الْبَابَ سُجَّداً وَّقُوْلُوْا حِطَّةٌ نَّغْفِرْ لَكُمْ خَطَايَاكُمْ
وَسَنَزِيْدُ الْمُحْسِنِيْنَ- (البقرة ৫৮)-
‘আর যখন আমরা বললাম, তোমরা প্রবেশ কর এ নগরীতে এবং
এতে যেখানে খুশী খেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ কর এবং নগরীর ফটক দিয়ে প্রবেশ
করার সময় সিজদা কর ও বলতে থাক (হে আল্লাহ!) ‘আমাদিগকে ক্ষমা করে দাও’-
তাহ’লে আমরা তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং সৎকর্মশীলদের আমরা সত্বর
অতিরিক্তভাবে আরও দান করব’ (বাক্বারাহ ২/৫৮)। কিন্তু এই অবাধ্য
জাতি এতটুকু আনুগত্য প্রকাশ করতেও রাযী হয়নি। তাদেরকে শুকরিয়ার সিজদা করতে
বলা হয়েছিল এবং আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চেয়ে ‘হিত্ত্বাহ’ (حطة) অর্থাৎ حُط ذنوبنا অথবাاحطط عنا ذنوبنا حطة
‘আমাদের পাপসমূহ পুরোপুরি মোচন করুন’ বলতে বলতে শহরে প্রবেশের নির্দেশ
দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেআদবীর চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে তারা হিত্ত্বাহ-এর বদলে
‘হিন্ত্বাহ’ (حنطة) অর্থাৎ ‘গমের দানা’ বলতে বলতে এবং সিজদা বা মাথা নীচু করার পরিবর্তে পিছন দিকে পিঠ ফিরে প্রবেশ করল।[48] এর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে আল্লাহ পূজারীর বদলে পেটপূজারী বলে প্রমাণ করল।
এখানে هذه القرية বা ‘এই নগরী’ বলতে বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে বুঝানো হয়েছে। যার ব্যাখ্যা মায়েদাহ ২১ আয়াতে এসেছে, الأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ
বলে। তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছর বন্দী জীবন কাটানোর পর নবী ইউশা‘ বিন নূন-এর
নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে তারা বিজয় লাভ করে ও নগরীতে প্রবেশ করে (ইবনু কাছীর)। এভাবে তাদের দীর্ঘ বন্দীত্বের অবসান ঘটে।
অথচ যদি প্রথমেই তারা মূসার হুকুম মেনে নিয়ে জিহাদে
অবতীর্ণ হ’ত, তাহ’লে তখনই তারা বিজয়ী হয়ে নগরীতে প্রবেশ করত। কিন্তু নবীর
অবাধ্যতা করার কারণেই তাদের ৪০ বছর কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হ’ল। পরিশেষে
তাদেরকে সেই জিহাদই করতে হ’ল, যা তারা প্রথমে করেনি ভীরুতা ও কাপুরুষতার
কারণে। বস্ত্ততঃ ভীরু ব্যক্তি ও জাতি কখনো সম্মানিত হয় না। উল্লেখ্য যে,
বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উক্ত প্রধান ফটককে আজও ‘বাব হিত্ত্বাহ’ (باب حطة) বলা হয়ে থাকে (কুরতুবী)।
আল্লাহ বলেন,
فَبَدَّلَ
الَّذِيْنَ ظَلَمُواْ قَوْلاً غَيْرَ الَّذِيْ قِيْلَ لَهُمْ
فَأَنْزَلْنَا عَلَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا رِجْزاً مِّنَ السَّمَاءِ
بِمَا كَانُوْا يَفْسُقُوْنَ- (البقرة ৫৯)-
‘অতঃপর যালেমরা সে কথা পাল্টে দিল, যা তাদেরকে বলতে
বলা হয়েছিল। ফলে আমরা যালেমদের উপর তাদের অবাধ্যতার কারণে আসমান থেকে গযব
নাযিল করলাম’ (বাক্বারাহ ২/৫৯)। তবে সেটা যে কি ধরনের গযব ছিল, সে
বিষয়ে কুরআন পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। ইতিহাসও এ ব্যাপারে নীরব। তবে
সাধারণতঃ এগুলি প্লেগ-মহামারী, বজ্রনিনাদ, ভূমিকম্প প্রভৃতি হয়ে থাকে। যা
বিভিন্ন নবীর অবাধ্য উম্মতদের বেলায় ইতিপূর্বে হয়েছে।
হিনত্বাহ ও হিত্ত্বাহ বলার মাধ্যমে আল্লাহ
বস্ত্তবাদী ও আদর্শবাদী দু’প্রকার মানুষের পার্থক্য তুলে ধরেছেন।
বস্ত্তবাদীরা বস্ত্ত পাওয়ার লোভে মানবতাকে ও মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করে।
পক্ষান্তরে ধার্মিক ও আদর্শবাদীরা তাদের ধর্ম ও আদর্শ রক্ষার জন্য
বস্ত্তকে উৎসর্গ করে। ফলে মানবতা রক্ষা পায় ও মানব সভ্যতা স্থায়ী হয়।
বাস্তবিক পক্ষে সে যুগ থেকে এ যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন নামে বস্ত্তবাদীগণ
মানবতার ধ্বংসকারী হিসাবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছে। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ
এবং বর্তমানের ইরাক ও আফগানিস্তানে স্রেফ তেল লুটের জন্য তথাকথিত
গণতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী রাষ্ট্রগুলির নেতাদের হুকুমে টন কে
টন বোমা মেরে লাখ লাখ নিরীহ বনু আদমের হত্যাকান্ড এরই প্রমাণ বহন করে। অথচ
কেবলমাত্র ধর্মই মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখে।
ইহুদীরা তাদের এলাহী কিতাব তওরাতের শাব্দিক পরিবর্তন
নবী মূসা (আঃ)-এর জীবদ্দশায় যেমন করেছিল, অর্থগত পরিবর্তনও তারা করেছিল।
যেমন মূসা (আঃ) যখন তাদের ৭০ জন নেতাকে সাথে নিয়ে তূর পাহাড়ে গেলেন। অতঃপর
আল্লাহর গযবে মৃত্যুবরণ করে পুনরায় তাঁর রহমতে জীবিত হয়ে ফিরে এল, তখনও
এই গর্বিত জাতি তওরাত যে আল্লাহর নাযিলকৃত গ্রন্থ এ সাক্ষ্য দেওয়ার সাথে
সাথে একথাও জুড়ে দিল যে, আল্লাহ তা‘আলা সবশেষে একথাও বলেছেন যে, তোমরা
যতটুকু পার, আমল কর। আর যা না পার তা আমি ক্ষমা করে দিব’। অথচ এটা ছিল
সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা। তাদের এই মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলে লোকেরা বলে দিল যে,
তওরাতের বিধান সমূহ মেনে চলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
তখনই আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতাগণ তূর পাহাড়ের একাংশ
উপরে তুলে ধরে তাদের হুকুম দিলেন, হয় তোমরা তওরাত মেনে নাও, না হয় ধ্বংস
হও। তখন নিরুপায় হয়ে তারা তওরাত মেনে নেয়।[49]
মূসা (আঃ)-এর মৃত্যুর পরেও তওরাত, যবূর ও ইঞ্জীল
গ্রন্থগুলিতে তারা অসংখ্য শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ফলে এই
কিতাবগুলি আসল রূপে কোথাও আর পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই। ইহুদীদের তওরাত
পরিবর্তনের ধরন ছিল তিনটি। এক. অর্থ ও মর্মগত পরিবর্তন, যা উপরে বর্ণিত
হয়েছে। দুই. শব্দগত পরিবর্তন যেমন আল্লাহ বলেন, مِّنَ الَّذِينَ هَادُواْ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَن مَّوَاضِعِهِ،
‘ইহুদীদের মধ্যে একটা দল আছে, যারা আল্লাহর কালামকে (যেখানে শেষনবীর আগমন
সংবাদ ও তাঁর গুণাবলী সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে) তার স্বস্থান হ’তে পরিবর্তন
করে দেয়’ (নিসা ৪/৪৬; মায়েদাহ ৫/১৩, ৪১)। এই পরিবর্তন তারা
নিজেদের দুনিয়াবী স্বার্থে শাব্দিকভাবে এবং মর্মগতভাবে উভয়বিধ প্রকারে করত।
‘এভাবে তারা কখনো শব্দে, কখনো অর্থে এবং কখনো তেলাওয়াতে (মুখ ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে) পরিবর্তন করত। পরিবর্তনের এ প্রকারগুলি কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত
হয়েছে। আজকাল পাশ্চাত্যের কিছু সংখ্যক খ্রীষ্টানও একথা কিছু কিছু স্বীকার
করে’।[50]
আল্লাহর কিতাবের এইসব পরিবর্তন তাদের মধ্যকার আলেম ও
যাজক শ্রেণীর লোকেরাই করত, সাধারণ মানুষ যাদেরকে অন্ধ ভক্তির চূড়ান্ত
স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَيْلٌ لِّلَّذِيْنَ يَكْتُبُوْنَ
الْكِتَابَ بِأَيْدِيْهِمْ ثُمَّ يَقُوْلُوْنَ هَـذَا مِنْ عِنْدِ اللهِ
لِيَشْتَرُوْا بِهِ ثَمَناً قَلِيْلاً- (البقرة ৭৯)-
‘ধ্বংস
ঐসব লোকদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে বলত, এটি আল্লাহর পক্ষ হ’তে
অবতীর্ণ হয়েছে- যাতে এর বিনিময়ে তারা সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারে’ (বাক্বারাহ ২/৭৯)।
আল্লাহ বলেন, سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ أَكَّالُونَ لِلسُّحْتِ ‘এইসব লোকেরা মিথ্যা কথা শোনাতে এবং হারাম ভক্ষণে অভ্যস্ত’ (মায়েদাহ ৫/৪২)।
জনগণ তাদের কথাকেই সত্য ভাবত এবং এর বিপরীত কিছুই তারা শুনতে চাইত না।
এভাবে তারা জনগণের রব-এর আসন দখল করেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, اتَّخَذُواْ أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَاباً مِّنْ دُونِ اللهِ ‘তারা তাদের আলেম ও দরবেশগণকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছিল আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে’ (তওবাহ ৯/৩১)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, إِنَّهُمْ
لَمْ يَأمُرُوْهُمْ أَنْ يَّسْجُدُوْا لَهُمْ وَلَكِنْ أَمَرُوْهُمْ
بِمَعْصِيَةِ اللهِ فَأَطَاعُوْهُمْ فَسَمَّاهُمُ اللهُ بِذَالِكَ
أَرْبَاباً- ‘তারা
তাদেরকে সিজদা করতে বলত না বটে। কিন্তু মানুষকে তারা আল্লাহর
অবাধ্যতামূলক কাজের নির্দেশ দিত এবং তারা তা মেনে নিত। সেকারণ আল্লাহ
তাদেরকে ‘রব’ বলে আখ্যায়িত করেন’। খৃষ্টান পন্ডিত ‘আদী বিন হাতেম যখন বললেন
যে, لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ ‘আমরা আমাদের আলেম-দরবেশদের পূজা করি না’। তখন তার জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَلَيْسَ يُحَرِّمُوْنَ مَا أحَّل اللهُ فَتُحَرِّمُوْنَهُ وَ يُحِلُّوْنَ مَا حَرَّمَ اللهُ فَتُحِلُّوْنَهُ
‘তারা কি আল্লাহকৃত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করে না? আর তোমরাও কি
সেটা মেনে নাও না? ‘আদী বললেন, হাঁ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ ‘সেটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।[51]
বনু ইস্রাঈলের জনৈক যুবক তার একমাত্র চাচাতো বোনকে
বিয়ে করে তার চাচার অগাধ সম্পত্তির একক মালিক বনতে চায়। কিন্তু চাচা তাতে
রাযী না হওয়ায় সে তাকে গোপনে হত্যা করে। পরের দিন বাহ্যিকভাবে কান্নাকাটি
করে চাচার রক্তের দাবীদার সেজে কওমের নেতাদের কাছে বিচার দেয়। কিন্তু
সাক্ষীর অভাবে আসামী শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। ইতিমধ্যে মূসা (আঃ) অহী মারফত
জেনে গিয়েছিলেন যে, বাদী স্বয়ং আসামী এবং সেই-ই একমাত্র হত্যাকারী।
এমতাবস্থায় সম্প্রদায়ের নেতারা এসে বিষয়টি ফায়ছালার জন্য মূসা (আঃ)-কে
অনুরোধ করল। মূসা (আঃ) তখন আল্লাহর হুকুম মোতাবেক যে ফায়ছালা দিলেন, সে
বিষয়ে আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَتَلْتُمْ نَفْساً فَادَّارَأْتُمْ فِيْهَا وَاللهُ مُخْرِجٌ مَّا كُنْتُمْ تَكْتُمُوْنَ
‘যখন তোমরা একজনকে হত্যা করে পরে সে সম্পর্কে একে অপরকে দায়ী করছিলে। অথচ
আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিলেন, যা তোমরা গোপন করতে চাচ্ছিলে’ (বাক্বারাহ ২/৭২)। কিভাবে আল্লাহ সেটা প্রকাশ করে দিলেন, তার বিবরণ নিম্নরূপ:
‘যখন মূসা স্বীয় কওমকে বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে একটা
গাভী যবেহ করতে বলেছেন। তারা বলল, আপনি কি আমাদের সাথে উপহাস করছেন? তিনি
বললেন, জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি’
(বাক্বারাহ ৬৭)। ‘তারা বলল, তাহ’লে আপনি আপনার পালনকর্তার নিকটে
আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন, যেন তিনি বলে দেন, গাভীটি কেমন হবে? তিনি
বললেন, আল্লাহ বলেছেন গাভীটি এমন হবে, যা না বুড়ী না বকনা, বরং দু’য়ের
মাঝামাঝি বয়সের হবে। এখন তোমাদের যা আদেশ করা হয়েছে, তা সেরে ফেল’ (৬৮)।
‘তারা বলল, আপনার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষ থেকে প্রার্থনা করুন যে,
গাভীটির রং কেমন হবে। তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, গাভীটি হবে চকচকে গাঢ় পীত
বর্ণের, যা দর্শকদের চক্ষু শীতল করবে’ (৬৯)। ‘লোকেরা আবার বলল,
আপনি আপনার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা করুন, যাতে তিনি বলে দেন
যে, গাভীটি কিরূপ হবে। কেননা একই রংয়ের সাদৃশ্যপূর্ণ গাভী অনেক রয়েছে।
আল্লাহ চাহে তো এবার আমরা অবশ্যই সঠিক দিশা পেয়ে যাব’ (৭০)।
‘তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, সে গাভীটি এমন হবে, যে কখনো ভূমি কর্ষণ বা
পানি সেচনের শ্রমে অভ্যস্ত নয়, সুঠামদেহী ও খুঁৎহীন’। ‘তারা বলল, এতক্ষণে
আপনি সঠিক তথ্য এনেছেন। অতঃপর তারা সেটা যবেহ করল। অথচ তারা (মনের থেকে)
তা যবেহ করতে চাচ্ছিল না’ (বাক্বারাহ ২/৬৭-৭১)।
আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমি বললাম, যবেহকৃত গরুর গোশতের
একটি টুকরা দিয়ে মৃত ব্যক্তির লাশের গায়ে আঘাত কর। এভাবে আল্লাহ মৃতকে
জীবিত করেন এবং তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শন সমূহ প্রদর্শন করেন। যাতে তোমরা
চিন্তা কর’ (বাক্বারাহ ২/৭৩)।
বলা বাহুল্য, গোশতের টুকরা দিয়ে আঘাত করার সাথে সাথে
মৃত লোকটি জীবিত হ’ল এবং তার হত্যাকারী ভাতিজার নাম বলে দিয়ে পুনরায় মারা
গেল। ধারণা করা চলে যে, মূসা (আঃ) সেমতে শাস্তি বিধান করেন এবং হত্যাকারী
ভাতিজাকে হত্যার মাধ্যমে ‘ক্বিছাছ’ আদায় করেন।
কিন্তু এতবড় একটা অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেও এই হঠকারী কওমের হৃদয় আল্লাহর প্রতি অনুগত হয়নি। তাই আল্লাহ বলেন, ثُمَّ قَسَتْ قُلُوْبُكُمْ مِّنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً ‘অতঃপর তোমাদের হৃদয় শক্ত হয়ে গেল। যেন তা পাথর, এমনকি তার চেয়েও শক্ত... (বাক্বারাহ ২/৭৪)।
(১) এখানে প্রথম যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে, সেটি এই যে,
আল্লাহর উপরে পূর্ণরূপে ভরসা করলে অনেক সময় যুক্তিগ্রাহ্য বস্ত্তর বাইরের
বিষয় দ্বারা সত্য প্রকাশিত হয়। যেমন এখানে গরুর গোশতের টুকরা মেরে মৃতকে
জীবিত করার মাধ্যমে হত্যাকারী শনাক্ত করানোর ব্যবস্থা করা হ’ল। অথচ বিষয়টি
ছিল যুক্তি ও স্বাভাবিক জ্ঞানের বিরোধী।
(২) মধ্যম বয়সী গাভী কুরবানীর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে,
নৈতিকভাবে মৃত জাতিকে পুনর্জীবিত করতে হ’লে পূর্ণ নৈতিকতা সম্পন্ন
ঈমানদার যুবশক্তির চূড়ান্ত ত্যাগ ও কুরবানী আবশ্যক।
(৩) নবী-রাসূলগণের আনুগত্য এবং তাঁদের প্রদত্ত শারঈ
বিধান সহজভাবে মেনে নেওয়ার মধ্যেই জাতির মঙ্গল নিহিত। বিতর্কে লিপ্ত হ’লে
বিধান কঠোর হয় এবং আল্লাহর গযব অবশ্যম্ভাবী হয়। যেমন বনু ইস্রাঈলগণ যদি
প্রথম নির্দেশ অনুযায়ী যেকোন একটা গাভী যবেহ করত, তবে তাতেই যথেষ্ট হ’ত।
কিন্তু তারা যত বেশী প্রশ্ন করেছে, তত বেশী বিধান কঠোর হয়েছে। এমনকি
অবশেষে হত্যাকারী চিহ্নিত হ’লেও আল্লাহর ক্রোধে তাদের হৃদয়গুলো পাথরের মত
শক্ত হয়ে গেছে।
(৪) এই গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয় ঘটনাকে চির জাগরুক
করে রাখার জন্য আল্লাহ পাক গাভীর নামে সূরা বাক্বারাহ নামকরণ করেন। এটিই
কুরআনের ২৮৬টি আয়াত সমৃদ্ধ সবচেয়ে বড় ও বরকতমন্ডিত সূরা। এই সূরার ফযীলত
বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা তোমাদের গৃহগুলিকে কবরে পরিণত করো
না। নিশ্চয়ই শয়তান ঐ ঘর থেকে পালিয়ে যায়, যে ঘরে সূরা বাক্বারাহ পাঠ করা
হয়’।[52] এ সূরার মধ্যে আয়াতুল কুরসী (২৫৫ নং আয়াত) রয়েছে, যাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘শ্রেষ্ঠতম’ (اعظم) আয়াত বলে বর্ণনা করেছেন।[53]
নবী মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে বারবার বেআদবী ও অবাধ্যতার
পরিণামে এবং আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার ও পরবর্তীতে নবীগণকে অন্যায়
ভাবে হত্যার কারণে আল্লাহ তাদের উপরে চিরস্থায়ী গযব ও অভিসম্পাৎ নাযিল
করলেন। আল্লাহ বলেন, وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ وَبَآؤُوْا بِغَضَبٍ مِّنَ اللهِ ‘আর তাদের উপরে লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা আরোপিত হ’ল এবং তারা আল্লাহর রোষানলে পতিত হ’ল’ (বাক্বারাহ ২/৬১)।
ইবনু কাছীর বলেন, এ লাঞ্ছনা ও অবমাননার প্রকৃতি হ’ল,
ইহুদীরা সর্বদা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপরের দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ
থাকবে। এ মর্মে সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ বলেন, ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ أَيْنَ مَا ثُقِفُواْ إِلاَّ بِحَبْلٍ مِّنَ اللهِ وَحَبْلٍ مِّنَ النَّاسِ ‘তাদের উপরে লাঞ্ছনা আরোপিত হ’ল যেখানেই তারা অবস্থান করুক না কেন। তবে আল্লাহ প্রদত্ত ও মানব প্রদত্ত মাধ্যম ব্যতীত’ (আলে ইমরান ৩/১১২)।
‘আল্লাহ প্রদত্ত মাধ্যম’ বলতে বুঝানো হয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ নিজ চিরন্তন
বিধান অনুযায়ী আশ্রয় ও অভয় দিয়েছেন। যেমন শিশু ও রমণীকুল এবং এমন সাধক ও
উপাসকগণ, যারা যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে দূরে থাকেন। এরা নিরাপদে থাকবে। অতঃপর
‘মানব প্রদত্ত মাধ্যম’ হ’ল, অন্যের সাথে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা
লাভ করা, যা মুসলমান বা অন্য যেকোন জাতির সাথে হ’তে পারে। যেমন বর্তমানে
তারা আমেরিকা ও পাশ্চাত্য শক্তি বলয়ের সাথে গাটছড়া বেঁধে টিকে আছে।
ইহুদীদের উপর চিরস্থায়ী গযব নাযিলের ব্যাপারে সূরা আ‘রাফে আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكَ لَيَبْعَثَنَّ
عَلَيْهِمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَن يَّسُوْمُهُمْ سُوْءَ
الْعَذَابِ إِنَّ رَبَّكَ لَسَرِيْعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُوْرٌ
رَّحِيْمٌ- (الأعراف ১৬৭)-
‘স্মরণ
কর সে সময়ের কথা, যখন তোমার প্রভু জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, নিশ্চয়ই তিনি
তাদের (ইহুদীদের) উপরে প্রেরণ করতে থাকবেন ক্বিয়ামত পর্যন্ত এমন সব শাসক,
যারা তাদের প্রতি পৌঁছাতে থাকবে কঠিন শাস্তিসমূহ। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু
দ্রুত বদলা গ্রহণকারী এবং নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আ‘রাফ ৭/১৬৭)।
উপরোক্ত আয়াত সমূহের আলোকে আমরা ইহুদীদের উপরে বিগত ও
বর্তমান যুগের লাঞ্ছনা ও অবমাননার দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করতে পারি।
তবে এখানে এতটুকু বলা আবশ্যক যে, হাযার বছর ধরে বসবাসকারী
ফিলিস্তীনের স্থায়ী মুসলিম নাগরিকদের তাড়িয়ে দিয়ে ১৯৪৮ সাল থেকে বৃটেন,
আমেরিকা, রাশিয়া প্রমুখ অশুভ শক্তি বলয়ের মাধ্যমে যবরদস্তিমূলকভাবে
প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ‘ইস্রাঈল’ নামক রাষ্ট্র মূলতঃ কোন রাষ্ট্রই নয়। বরং
মধ্যপ্রাচ্যের তৈলভান্ডার নিজেদের করায়ত্তে রাখার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের
বিশেষ করে আমেরিকা ও বৃটেনের ঘাঁটি বা অস্ত্রগুদাম মাত্র। বৃহৎ শক্তিগুলো
হাত গুটিয়ে নিলে তারা একমাসও নিজের শক্তিতে টিকতে পারবে কি-না সন্দেহ।
এতেই কুরআনী সত্য حَبْلٍ مِّنَ النَّاسِ
বা ‘মানব প্রদত্ত মাধ্যম’-এর বাস্তব রূপ প্রকাশিত হয়। ইনশাআল্লাহ এ
মাধ্যমও তাদের ছিন্ন হবে এবং তাদেরকে এই পবিত্র ভূমি মুসলমানদের হাতে ছেড়ে
দিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে অথবা ইসলাম কবুল করে শান্তিতে বসবাস করতে হবে।
এ ঘটনাটি বনু ইস্রাঈলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং
ঘটনাটি ব্যক্তিগতভাবে মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে জড়িত। পিতা ইবরাহীম (আঃ) সহ বড়
বড় নবী-রাসূলগণের জীবনে পদে পদে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। মূসা (আঃ)-এর জীবনে
এটাও ছিল অনুরূপ একটি পরীক্ষা। যে পরীক্ষায় জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়
সমূহ রয়েছে। আনুষঙ্গিক বিবরণ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনাটি তীহ্
প্রান্তরের উন্মুক্ত বন্দীশালায় থাকাকালীন সময়ে ঘটেছিল। ঘটনাটি নিম্নরূপ:
ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) প্রমুখাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছ হ’তে[54] এবং সূরা কাহফ ৬০ হ’তে ৮২ পর্যন্ত ২৩টি আয়াতে বর্ণিত বিবরণ থেকে যা জানা যায়, তার সংক্ষিপ্ত সার নিম্নে বিবৃত হ’ল।-
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, একদিন হযরত মূসা (আঃ) বনু
ইস্রাঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল,
লোকদের মধ্যে আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী কেউ আছে কি? ঐ সময়ে যেহেতু মূসা
ছিলেন শ্রেষ্ঠ নবী এবং তাঁর জানা মতে আর কেউ তাঁর চাইতে অধিক জ্ঞানী ছিলেন
না, তাই তিনি সরলভাবে ‘না’ সূচক জবাব দেন। জবাবটি আল্লাহর পসন্দ হয়নি।
কেননা এতে কিছুটা অহংকার প্রকাশ পেয়েছিল। ফলে আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষায়
ফেললেন। তাঁর উচিৎ ছিল একথা বলা যে, ‘আল্লাহই সর্বাধিক অবগত’। আল্লাহ
তাঁকে বললেন, ‘হে মূসা! দুই সমুদ্রের সংযোগস্থলে অবস্থানকারী আমার এক
বান্দা আছে, যে তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী’। একথা শুনে মূসা (আঃ) প্রার্থনা
করে বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে ঠিকানা বলে দিন, যাতে আমি সেখানে গিয়ে জ্ঞান
লাভ করতে পারি’। আল্লাহ বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নাও এবং দুই
সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের (সম্ভবতঃ লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের মিলনস্থল) দিকে
সফরে বেরিয়ে পড়। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি জীবিত হয়ে বেরিয়ে যাবে, সেখানেই
আমার সেই বান্দার সাক্ষাৎ পাবে’। মূসা (আঃ) স্বীয় ভাগিনা ও শিষ্য (এবং
পরবর্তীকালে নবী) ইউশা‘ বিন নূনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে এক
স্থানে সাগরতীরে পাথরের উপর মাথা রেখে দু’জন ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ সাগরের
ঢেউয়ের ছিটা মাছের গায়ে লাগে এবং মাছটি থলের মধ্যে জীবিত হয়ে নড়েচড়ে ওঠে ও
থলে থেকে বেরিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। ইউশা‘ ঘুম থেকে উঠে এই বিস্ময়কর দৃশ্য
প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু মূসা (আঃ) ঘুম থেকে উঠলে তাঁকে এই ঘটনা বলতে ভুলে
গেলেন। অতঃপর তারা আবার পথ চলতে শুরু করলেন এবং একদিন একরাত চলার পর
ক্লান্ত হয়ে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য বসলেন। অতঃপর মূসা (আঃ) নাশতা দিতে
বললেন। তখন তার মাছের কথা মনে পড়ল এবং ওযর পেশ করে আনুপূর্বিক সব ঘটনা
মূসা (আঃ)-কে বললেন এবং বললেন যে, ‘শয়তানই আমাকে একথা ভুলিয়ে দিয়েছিল’ (কাহফ ১৮/৬৩)। তখন মূসা (আঃ) বললেন, ঐ স্থানটিই তো ছিল আমাদের গন্তব্য স্থল।
ফলে তাঁরা আবার সেপথে ফিরে চললেন। অতঃপর সেখানে
পৌঁছে দেখতে পেলেন যে, একজন লোক আপাদ-মস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মূসা
(আঃ) তাকে সালাম করলেন। লোকটি মুখ বের করে বললেন, এদেশে সালাম? কে আপনি?
বললেন, আমি বনু ইস্রাঈলের মূসা। আপনার কাছ থেকে ঐ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি,
যা আল্লাহ আপনাকে বিশেষভাবে দান করেছেন’।
খিযির বললেন, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন
না হে মূসা! আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা তিনি আপনাকে দেননি।
পক্ষান্তরে আপনাকে তিনি যে জ্ঞান দান করেছেন, তা আমাকে দেননি’। মূসা
বললেন, ‘আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার কোন
আদেশ অমান্য করব না’ (কাহফ ১৮/৬৯)। খিযির বললেন, ‘যদি আপনি আমার
অনুসরণ করেনই, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি
নিজে সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলি’।
(১) অতঃপর তাঁরা চলতে লাগলেন। কিছু দূর গিয়ে নদী পার
হওয়ার জন্য একটা নৌকা পেলেন। অতঃপর নৌকা থেকে নামার সময় তাতে ছিদ্র করে
দিলেন। শারঈ বিধানের অধিকারী নবী মূসা বিষয়টিকে মেনে নিতে পারলেন না।
কেননা বিনা দোষে অন্যের নৌকা ছিদ্র করে দেওয়া স্পষ্টভাবেই অন্যায়। তিনি
বলেই ফেললেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি একটা গুরুতর মন্দ কাজ করলেন’। তখন খিযির
বললেন, আমি কি পূর্বেই বলিনি যে, ‘আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন
না’। মূসা ক্ষমা চাইলেন। ইতিমধ্যে একটা কালো চড়ুই পাখি এসে নৌকার এক
প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। সে দিকে ইঙ্গিত করে
খিযির মূসা (আঃ)-কে বললেন, علمي و علمك و علم الخلائق فى علم الله إلا مقدار ما غمس هذا العصفور منقاره
‘আমার ও আপনার এবং সমস্ত সৃষ্টিজগতের জ্ঞান মিলিতভাবে আল্লাহর জ্ঞানের
মুকাবিলায় সমুদ্রের বুক থেকে পাখির চঞ্চুতে উঠানো এক ফোঁটা পানির
সমতুল্য’।[55]
(২) তারপর তাঁরা সমুদ্রের তীর বেয়ে চলতে থাকলেন। কিছু
দূর গিয়ে তাঁরা সাগরপাড়ে খেলায় রত একদল বালককে দেখলেন। খিযির তাদের মধ্যে
সবচেয়ে সুন্দর ও বুদ্ধিমান ছেলেটিকে ধরে এনে নিজ হাতে তাকে হত্যা করলেন। এ
দৃশ্য দেখে মূসা আৎকে উঠে বললেন, একি! একটা নিষ্পাপ শিশুকে আপনি হত্যা
করলেন? এ যে মস্তবড় গোনাহের কাজ’। খিযির বললেন, আমি তো পূর্বেই বলেছিলাম,
আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা আবার ক্ষমা চাইলেন এবং বললেন,
‘এরপর যদি আমি কোন প্রশ্ন করি, তাহ’লে আপনি আমাকে আর সাথে রাখবেন না’ (কাহফ ১৮/৭৫)।
(৩) ‘অতঃপর তারা চলতে লাগলেন। অবশেষে যখন একটি জনপদে
পৌঁছলেন, তখন তাদের কাছে খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাদের আতিথেয়তা করতে
অস্বীকার করল। অতঃপর তারা সেখানে একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেয়ে
সেটাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তখন মূসা বললেন, আপনি ইচ্ছা করলে তাদের
কাছ থেকে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতে পারতেন’। খিযির বললেন هَذَا فِرَاقُ بَيْنِي وَبَيْنِكَ سَأُنَبِّئُكَ بِتَأْوِيلِ مَا لَمْ تَسْتَطِعْ عَلَيْهِ صَبْراً ‘এখানেই আমার ও আপনার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হ’ল। এখন যেসব বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি, আমি সেগুলির তাৎপর্য বলে দিচ্ছি’ (কাহফ ১৮/৭৮)।
প্রথমতঃ নৌকা ছিদ্র করার বিষয়। সেটা ছিল কয়েকজন
মিসকীন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা এ দিয়ে সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি
সেটিকে ছিদ্র করে দিলাম এজন্য যে, ঐ অঞ্চলে ছিল এক যালেম বাদশাহ। সে
বলপ্রয়োগে লোকদের নৌকা ছিনিয়ে নিত’। নিশ্চয়ই ছিদ্র নৌকা সে নিবে না। ফলে
দরিদ্র লোকগুলি নৌকার সামান্য ত্রুটি সেরে নিয়ে পরে তাদের কাজে লাগাতে
পারবে।
দ্বিতীয়তঃ বালকটিকে হত্যার ব্যাপার। তার পিতা-মাতা
ছিল ঈমানদার। আমি আশংকা করলাম যে, সে বড় হয়ে অবাধ্য হবে ও কাফের হবে। যা
তার বাপ-মায়ের জন্য ফিৎনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমি চাইলাম যে, দয়ালু
আল্লাহ তার পিতা-মাতাকে এর বদলে উত্তম সন্তান দান করুন, যে হবে সৎকর্মশীল ও
বিশুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী। যে তার পিতা-মাতাকে শান্তি দান করবে’।
তৃতীয়তঃ পতনোন্মুখ প্রাচীর সোজা করে দেওয়ার ব্যাপার।
উক্ত প্রাচীরের মালিক ছিল নগরীর দু’জন পিতৃহীন বালক। ঐ প্রাচীরের নীচে
তাদের নেককার পিতার রক্ষিত গুপ্তধন ছিল। আল্লাহ চাইলেন যে, বালক দু’টি
যুবক হওয়া পর্যন্ত প্রাচীরটি খাড়া থাক এবং তারা তাদের প্রাপ্য গুপ্তধন
হস্তগত করুক। (খিযির বলেন,) وَمَا فَعَلْتُهُ عَنْ أَمْرِىْ ‘বস্ত্ততঃ আমি নিজ ইচ্ছায় এ সবের কিছুই করিনি’ (কাহফ ১৮/৮২)।
(১) বড় যুলুম থেকে বাঁচানোর জন্য কারু উপরে ছোট-খাট
যুলুম করা যায়। যেমন নৌকা ছিদ্র করা থেকে এবং বালকটিকে হত্যা করা থেকে
প্রমাণিত হয়। তবে শরী‘আতে মুহাম্মাদীতে এগুলি সবই সামাজিক বিধি-বিধান
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিশেষ করে হত্যাকান্ডের মত বিষয় একমাত্র
রাষ্ট্রানুমোদিত বিচার কর্তৃপক্ষ ব্যতীত কারু জন্য অনুমোদিত নয়। (২)
পিতা-মাতার সৎকর্মের ফল সন্তানরাও পেয়ে থাকে। যেমন সৎকর্মশীল পিতার রেখে
যাওয়া গুপ্তধন তার সন্তানরা যাতে পায়, সেজন্য খিযির সাহায্য করলেন।
তাছাড়া এ বিষয়েও ইঙ্গিত রয়েছে যে, আলেম ও সৎকর্মশীলগণের সন্তানদের প্রতি
সকলেরই স্নেহ পরায়ণ হওয়া কর্তব্য। (৩) মানুষ অনেক সময় অনেক বিষয়কে ভাল মনে
করে। কিন্তু সেটি তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,
عَسَى أَن تَكْرَهُوْا شَيْئاً وَهُوَ
خَيْرٌ لَّكُمْ وَعَسَى أَن تُحِبُّوْا شَيْئاً وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ
وَاللهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لاَ تَعْلَمُون- (البقرة ২১৬)-
‘তোমরা অনেক বিষয়কে অপসন্দ কর। অথচ সেটি তোমাদের জন্য
কল্যাণকর। আবার অনেক বিষয় তোমরা ভাল মনে কর, কিন্তু সেটি তোমাদের জন্য
ক্ষতিকর। বস্ত্ততঃ আল্লাহই প্রকৃত অবস্থা জানেন, তোমরা জানো না’ (বাক্বারাহ ২/২১৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لايَقْضِى اللهُ للمؤمن من قضاءٍ الا كان خيرًا له ‘আল্লাহ তার মুমিন বান্দার জন্য যা ফায়ছালা করেন, তা কেবল তার মঙ্গলের জন্যই হয়ে থাকে’।[56]
(৪) অতঃপর আরেকটি মৌলিক বিষয় এখানে রয়েছে যে, মূসা ও
খিযিরের এ শিহরণমূলক কাহিনীটি ছিল ‘আগাগোড়া একটি বিশেষ প্রশিক্ষণের
বহিঃপ্রকাশ’। থলের মধ্যেকার মরা মাছ জীবিত হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সাগরে চলে
যাওয়া যেমন সাধারণ নিয়ম বহির্ভূত বিষয়, তেমনি আল্লাহ পাক কোন ফেরেশতাকে
খিযিরের রূপ ধারণ করে মূসাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যও পাঠিয়ে থাকতে পারেন।
যাকে তিনি সাময়িকভাবে শরী‘আতী ইলমের বাইরে অলৌকিক ও অতীন্দ্রিয় জ্ঞান দিয়ে
পাঠিয়েছিলেন, যা মূসার জ্ঞানের বাইরে ছিল। এর দ্বারা আল্লাহ মূসা সহ সকল
মানুষের জ্ঞানের স্বল্পতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
(৫) বান্দার জন্য যে অহংকার নিষিদ্ধ, অত্র ঘটনায় সেটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয়।
কুরআনে তাঁকে عَبْداً مِّنْ عِبَادِنَا ‘আমাদের বান্দাদের একজন’ (কাহফ ১৮/৬৫) বলা হয়েছে। বুখারী শরীফে তাঁর নাম খিযির (خضر)
বলে উল্লেখ করা হয়েছে’। সেখানে তাঁকে নবী বলা হয়নি। জনশ্রুতি মতে তিনি
একজন ওলী ছিলেন এবং মৃত্যু হয়ে গেলেও এখনও মানুষের বেশ ধরে যেকোন সময়
যেকোন মানুষের উপকার করেন। ফলে জঙ্গলে ও সাগর বক্ষে বিপদাপদ থেকে বাঁচার
জন্য আজও অনেকে খিযিরের অসীলা পাবার জন্য তার উদ্দেশ্যে মানত করে থাকে।
এসব ধারণার প্রসার ঘটেছে মূলতঃ বড় বড় প্রাচীন মনীষীদের নামে বিভিন্ন
তাফসীরের কেতাবে উল্লেখিত কিছু কিছু ভিত্তিহীন কল্পকথার উপরে ভিত্তি করে।
যারা তাকে নবী বলেন, তাদের দাবীর ভিত্তি হ’ল, খিযিরের বক্তব্য وَمَا فَعَلْتُهُ عَنْ أَمْرِيْ ‘আমি এসব নিজের মতে করিনি’ (কাহফ ১৮/৮২)।
অর্থাৎ সবকিছু আল্লাহর নির্দেশে করেছি। অলীগণের কাশ্ফ-ইলহাম শরী‘আতের
দলীল নয়। কিন্তু নবীগণের স্বপ্নও আল্লাহর অহী হয়ে থাকে। যেজন্য ইবরাহীম
(আঃ) স্বীয় পুত্রকে যবেহ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। অতএব বালক হত্যার মত ঘটনা
কেবলমাত্র নবীর পক্ষেই সম্ভব, কোন অলীর পক্ষে আদৌ নয়। কিন্তু সেখানেও
প্রশ্ন থেকে যায় যে, নবী কখনো শরী‘আত বিরোধী কাজ করতে পারেন না। ঐ সময়
শরী‘আতধারী নবী ও রাসূল ছিলেন হযরত মূসা (আঃ)। আর সে কারণেই খিযিরের
শরী‘আত বিরোধী কাজ দেখে তিনি বারবার প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। এ
ব্যাপারে সবাই একমত যে, খিযির কোন কেতাবধারী রাসূল ছিলেন না, বা তাঁর কোন
উম্মত ছিল না।
এখানে আমরা যদি বিষয়টিকে কুরআনের প্রকাশ্য অর্থের
উপরে ছেড়ে দিই এবং তাঁকে ‘আল্লাহর একজন বান্দা’ হিসাবে গণ্য করি, যাঁকে
আল্লাহর ভাষায় آتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِندِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِن لَّدُنَّا عِلْماً ‘আমরা আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ রহমত দান করেছিলাম এবং আমাদের পক্ষ হ’তে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান’ (কাহফ ১৮/৬৫)।
তাহ’লে তিনি নবী ছিলেন কি অলী ছিলেন, তিনি এখনো বেঁচে আছেন, না মারা
গেছেন, এসব বিতর্কের আর কোন অবকাশ থাকে না। যেভাবে মূসার মায়ের নিকটে
আল্লাহ অহী (অর্থাৎ ইলহাম) করেছিলেন এবং যার ফলে তিনি তার সদ্য প্রসূত
সন্তান মূসাকে বাক্সে ভরে সাগরে নিক্ষেপ করতে সাহসী হয়েছিলেন (ত্বোয়াহা ২০/৩৮-৩৯) এবং যেভাবে জিব্রীল মানুষের রূপ ধরে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ছাহাবীগণকে দ্বীনের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন[57] একই ধরনের ঘটনা মূসা ও খিযিরের ক্ষেত্রে হওয়াটাও বিস্ময়কর কিছু নয়।
মনে রাখা আবশ্যক যে, লোকমান অত্যন্ত উঁচুদরের একজন
জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তাঁর জ্ঞানপূর্ণ উপদেশসমূহ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং
তার নামে একটি সূরা নাযিল হয়েছে। কিন্তু তিনি নবী ছিলেন না। লোকমানকে
আল্লাহ যেমন বিশেষ ‘হিকমত’ দান করেছিলেন (লোকমান ৩১/১২)। খিযিরকেও তেমনি বিশেষ ‘ইল্ম’ দান করেছিলেন (কাহফ ১৮/৬৫)। এটা বিচিত্র কিছু নয়।
(১) মূসা (আঃ)-এর সিন্দুক ও নবীগণের ছবি :
বাক্বারাহ ২৪৮ : إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ أَن يَّأْتِيَكُمُ التَّابُوْتُ ‘তাদের নবী (শ্যামুয়েল) তাদেরকে বললেন (ত্বালূতের) রাজা হওয়ার নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকটে সেই ‘তাবূত’ (সিন্দুক) আসবে...।’
এখানে তাবূত-এর ব্যাখ্যায় (ক) তাফসীর জালালাইনে বলা হয়েছে, الصندوق كان فيه صور الأنبياء، أنزله الله على أدم- ‘সেই সিন্দুক, যা আল্লাহ আদম (আঃ)-এর উপরে নাযিল করেন এবং যার মধ্যে রয়েছে নবীদের ছবিসমূহ’। (খ) তাফসীর কাশশাফে বলা হয়েছে, التابوت هي صورة كانت فيه من زبرجد أو ياقوت لها رأس كرأس الهر وذنب كذنبه وجناحان ‘উক্ত
তাবূত হ’ল একটি মূর্তি, যার মধ্যে যবরজদ ও ইয়াকূত মণি-মুক্তা সমূহ রয়েছে।
উক্ত তাবূতের মাথা ও লেজ মদ্দা বিড়ালের মাথা ও লেজের ন্যায়, যার দু’টি
ডানা রয়েছে।’ (গ) তাফসীর বায়যাবীতে বলা হয়েছে, وفيه صورة الأنبياء من آدم إلى محمد ‘তাতে নবীগণের ছবি রয়েছে আদম (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত।’
(ঘ) ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশিত বঙ্গানুবাদ কুরআন শরীফে (পৃঃ ৬৩ টীকা ১৭০) বলা হয়েছে, ‘বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা কালে হযরত মূসা (আঃ) ইহা সম্মুখে স্থাপন করিতেন’।
উপরে বর্ণিত কোন ব্যাখ্যাই কুরআন ও হাদীছ সম্মত নয়।
বরং প্রকৃত কথা এই যে, এটি হ’ল আল্লাহর হুকুম মোতাবেক মূসা (আঃ)-এর তৈরী
সেই সিন্দুক, যার মধ্যে তাঁর লাঠি, তাওরাত এবং তাঁর ও হারূণ (আঃ)-এর
পরিত্যক্ত অন্যান্য পবিত্র বস্ত্তসমূহ সংরক্ষিত ছিল। বনু ইস্রাঈলগণ এটিকে
বরকত হিসাবে ও বিজয়ের নিদর্শন হিসাবে মনে করত।
(২) তাওরাতের পৃষ্ঠা সমূহ :
আ‘রাফ ১৪৫ : وَكَتَبْنَا لَهُ فِي الْأَلْوَاحِ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ مَّوْعِظَةً وَّتَفْصِيْلاً لِّكُلِّ شَيْءٍ
‘আমরা তার (মূসা) জন্য ফলকে (তাওরাতে পৃষ্ঠাসমূহে) সকল বিষয়ে উপদেশ ও
স্পষ্ট ব্যাখ্যাসমূহ লিখে দিয়েছি’। এর ব্যাখ্যায় তাফসীরে জালালাইনে বলা
হয়েছে, أي ألواح التوراة وكانت من سدر الجنة أو زبرجد أو زمرد سبعة أو عشرة ‘অর্থাৎ
তাওরাতের ফলক সমূহ, যা ছিল জান্নাতের পত্র সমূহ বা যবরজাদ অথবা
যুমুর্রুদ, যা ছিল ৭টি অথবা ১০টি’। অথচ এসব কথার কোন ভিত্তি নেই। ঐ
ফলকগুলির সংখ্যা কত ছিল, কি দিয়ে তৈরী ছিল, কতটুকু তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ
ছিল, কি দিয়ে ও কিভাবে সেখানে লেখা ছিল, এগুলি বিষয় জানা বা তার উপরে ঈমান
আনার কোন বাধ্যবাধকতা আমাদের উপরে নেই। কুরআন-হাদীছ এবিষয়ে চুপ রয়েছে।
আমরাও এ বিষয়ে চুপ থাকব। বস্ত্ততঃ এগুলি স্রেফ ইস্রাঈলী কল্পকাহিনী মাত্র।
১. আল্লাহ যালেম শাসক ও ব্যক্তিদেরকে নির্দিষ্ট সময়
পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা সংশোধিত না হ’লে সরাসরি আসমানী বা
যমীনী গযব প্রেরণ করেন অথবা অন্য কোন মানুষকে দিয়ে তাকে শাস্তি দেন ও
যুলুম প্রতিরোধ করেন। যেমন আল্লাহ উদ্ধত ফেরাঊনের কাছে প্রথমে মূসাকে
পাঠান। ২০ বছরের বেশী সময় ধরে তাকে উপদেশ দেওয়ার পরেও এবং নানাবিধ গযব
পাঠিয়েও তার ঔদ্ধত্য দমিত না হওয়ায় অবশেষে সাগরডুবির গযব পাঠিয়ে আল্লাহ
তাদেরকে সমূলে উৎখাত করেন।
২. দুনিয়াদার সমাজনেতারা সর্বদা যালেম শাসকদের সহযোগী
থাকে। পক্ষান্তরে মযলূম দ্বীনদার ব্যক্তিগণ সর্বদা দ্বীনদার সমাজ
সংস্কারক নেতৃত্বের মুখাপেক্ষী থাকে।
৩. দুনিয়া লোভী আন্দোলন নিজেকে অপদস্থ ও সমাজকে ধ্বংস
করে। পক্ষান্তরে আখেরাত পিয়াসী আন্দোলন নিজেকে সম্মানিত ও সমাজকে উন্নত
করে। যেমন দুনিয়াদার শাসক ফেরাঊন নিজেকে ও নিজের সমাজকে ধ্বংস করেছে এবং
নিজে এমনভাবে অপদস্থ হয়েছে যে, তার নামে কেউ নিজ সন্তানের নাম পর্যন্ত
রাখতে চায় না। পক্ষান্তরে মূসা (আঃ)-এর দ্বীনী আন্দোলন তাঁকে ও তাঁর
ঈমানদার সাথীদেরকে বিশ্ব মাঝে স্থায়ী সম্মান দান করেছে।
৪. দুনিয়াতে যালেম ও মযলূম উভয়েরই পরীক্ষা হয়ে থাকে।
যালেম তার যুলুমের চরম সীমায় পৌঁছে গেলে তাকে ধ্বংস করা হয়। অনুরূপভাবে
মযলূম সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে ভরসা করলে নির্দিষ্ট সময়ে তাকে সাহায্য
করা হয়। অধিকন্তু পরকালে সে জান্নাত লাভে ধন্য হয়।
৫. দ্বীনদার সংস্কারককে সর্বদা আল্লাহর সাহায্যের
উপরে নির্ভরশীল থাকতে হয় এবং কথায় ও আচরণে সামান্যতম অহংকার প্রকাশ করা
হ’তে বিরত থাকতে হয়। মূসা ও খিযিরের ঘটনায় আল্লাহ এ প্রশিক্ষণ দিয়ে সবাইকে
সেকথা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
৬. অহীর বিধানের অবাধ্যতা করলে আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত
জাতিও চিরস্থায়ী গযবের শিকার হ’তে পারে। বনু ইস্রাঈলগণ তার জ্বলজ্যান্ত
প্রমাণ। নবীগণের শিক্ষার বিরোধিতা করায় তাদের উপর থেকে আল্লাহর রহমত উঠে
যায় এবং তারা চিরস্থায়ী গযব ও লাঞ্ছনার শিকার হয়। ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এটি
একইভাবে প্রযোজ্য। ইস্রাঈলী দরবেশ আলেম বাল‘আম বা‘ঊরার ঘটনা এর প্রকৃষ্ট
প্রমাণ।
৭. জিহাদ বিমুখ জাতি কখনোই সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে
দুনিয়ায় বাঁচতে পারে না। আর সেকারণেই মিসরীয় জনগণের ১০ হ’তে ২০ শতাংশ হওয়া
সত্ত্বেও বনু ইস্রাঈলগণকে রাতের অন্ধকারে সেদেশ ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়।
অতঃপর জিহাদে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করায় তারা তাদের পিতৃভূমি বায়তুল
মুক্বাদ্দাস অধিকারে ব্যর্থ হয়। যার শাস্তি স্বরূপ দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাবত
তীহ প্রান্তরের উন্মুক্ত কারাগারে তারা বন্দীত্ব বরণে বাধ্য হয়। অবশেষে
নবী ইউশা-র নেতৃত্বে জিহাদ করেই তাদের পিতৃভূমি দখল করতে হয়।
৮. সংস্কারককে জাতির নিকট থেকে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়।
দুনিয়ায় তাঁর নিঃস্বার্থ সঙ্গী হাতে গণা কিছু লোক হয়ে থাকে। তাঁকে স্রেফ
আল্লাহর উপরে ভরসা করেই চলতে হয়। বিনিময়ে তিনি আখেরাতে পুরস্কৃত হন ও
পরবর্তী বংশধরের নিকটে যুগ যুগ ধরে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকেন। যেমন মূসার
প্রকৃত সাথী ছিলেন তার ভাই হারূণ ও ভাগিনা ইউশা‘ বিন নূন। বাকী অধিকাংশ ছিল
তাকে কষ্ট দানকারী ও স্বার্থপর সাথী । মূসা (আঃ) তাই দুঃখ করে তার কওমকে
বলেন, لِمَ تُؤْذُوْنَنِيْ وَقَد تَّعْلَمُوْنَ أَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ إِلَيْكُمْ ‘কেন তোমরা আমাকে কষ্ট দাও? অথচ তোমরা জানো যে, আমি তোমাদের নিকটে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল’ (ছফ ৬১/৫)।
উপসংহার :
মূসা ও হারূণ (আলাইহিমাস সালাম)-এর দীর্ঘ
কাহিনীর মাধ্যমে নবীদের কাহিনীর একটা বিরাট অংশ সমাপ্ত হ’ল। হারূণ ও মূসার
জীবনীতে ব্যক্তি মূসা ও গোষ্ঠী বনু ইস্রাঈলের উত্থান-পতনের যে ঘটনাবলী
বিবৃত হয়েছে, তা রীতিমত বিষ্ময়কর ও শিহরণ মূলক। একই সাথে তা মানবীয়
চরিত্রের তিক্ত ও মধুর নানাবিধ বাস্তবতায় মুখর। সমাজ সংস্কারক ও সমাজ
সচেতন যেকোন পাঠকের জন্য এ কাহিনী হবে খুবই শিক্ষণীয় ও তাৎপর্যমন্ডিত।
এক্ষণে আমাদের উচিত হবে এর আলোকে সমাজ সংস্কারে ব্রতী হওয়া এবং গভীর
ধৈর্যের সাথে আমাদের স্ব স্ব পরিবার, সমাজ ও জাতিকে অহি-র বিধানের আলোকে
গড়ে তোলা। আল্লাহ আমাদের সুপথ প্রদর্শন করুন- আমীন!
[1]. মুহাম্মাদ সালামাহ জাবর, তারীখুল আম্বিয়া (কুয়েত : মাকতাবা ছাহওয়াহ ১৪১৩/১৯৯৩), ১/১৩৬ পৃঃ।
[2].
যথাক্রমে (১) বাক্বারাহ ২/৪৯-৭৪=২৬, ৮৭, ৯২-৯৮=৭, ১০৮, ১৩৬, ২৪৬-২৪৮; (২)
আলে-ইমরান ৩/১১, ৮৪; (৩) নিসা ৪/৪৭, ১৫৩-১৫৫, ১৬৪; (৪) মায়েদাহ
৫/২০-২৬=৭; (৫) আন‘আম ৬/৮৪, ৯১, ১৫৪; (৬) আ‘রাফ ৭/১০৩-১৬২=৬০, ১৭১,
১৭৫-১৭৬; (৭) আনফাল ৮/৫২-৫৪=৩; (৮) ইউনুস ১০/৭৫-৯০=১৬; (৯) হূদ
১১/৯৬-১০১=৬, ১১০; (১০) ইবরাহীম ১৪/৫-৮=৪; (১১) ইসরা ১৭/২, ১০১-১০৪=৪;
(১২) কাহফ ১৮/৬০-৮২=২৩; (১৩) মারিয়াম ১৯/৫১-৫৩=৩; (১৪) ত্বোয়াহা
২০/৯-৯৯=৯১; (১৫) আম্বিয়া ২১/৪৮-৫০=৩; (১৬) হজ্জ ২২/৪৪; (১৭) মুমিনূন
২৩/৪৫-৪৯=৫; (১৮) ফুরক্বান ২৫/৩৫-৩৬; (১৯) শো‘আরা ২৬/১০-৬৮=৫৯; (২০) নমল
২৭/৭-১৪=৮; (২১) ক্বাছাছ ২৮/৩-৪৮=৪৬, ৭৬-৮৩=৮; (২২) আনক্বাবূত ২৯/৩৯-৪০;
(২৩) সাজদাহ ৩২/২৩-২৪; (২৪) আহযাব ৩৩/৭, ৬৯; (২৫) ছাফফাত ৩৭/১১৪-১২২=৯;
(২৬) ছোয়াদ ৩৮/১২; (২৭) গাফের/মুমিন ৪০/২৩-৫৪=৩২; (২৮) ফুছছিলাত/হা-মীম
সাজদাহ ৪১/৪৫; (২৯) শূরা ৪২/১৩ (৩০) যুখরুফ ৪৩/৪৬-৫৬=১১; (৩১) দুখান
৪৪/১৭-৩১=১৫; (৩২) আহক্বাফ ৪৬/১২, ৩০; (৩৩) ক্বাফ ৫০/১৩; (৩৪) নজম ৫৩/৩৬;
(৩৫) ছফ ৬১/৫ (৩৬) যারিয়াত ৫১/৩৮-৪০=৩; (৩৭) ক্বামার ৫৪/৪১-৪২; (৩৮) তাহরীম
৬৬/১১; (৩৯) হা-কক্বাহ ৬৯/৯; (৪০) মুযযাম্মিল ৭৩/১৫-১৬; (৪১) নাযি‘আত
৭৯/১৫-২৬=১২; (৪২) বুরূজ ৮৫/১৮; (৪৩) আ‘লা ৮৭/১৯ (৪৪) ফাজর ৮৯/১০।
সর্বমোট = ৫৩২টি।
[3].
মাওলানা মওদূদী, রাসায়েল ও মাসায়েল (ঢাকা: ১৯৯৬) ৫/৯৯ পৃ:; তানত্বাভী
জওহারী (মৃ: ১৯৪০খৃ:), আল-জাওয়াহের ফী তাফসীরিল কুরআনিল কারীম (বৈরুত:
দারুল ফিকর, তাবি) তাফসীর সূরা ইউনুস ৯২ দ্র: ৬/৮৪ পৃ:।
[4]. মুহাম্মাদ সালামাহ জাবর, তারীখুল আম্বিয়া (কুয়েত: মাকতাবা ছাহওয়াহ ১৪১৩/১৯৯৩) ১/১৩৭।
[5]. তারীখুল আম্বিয়া, পৃঃ ১২৪।
[6]. তারীখুল আম্বিয়া ১/১৪০।
[7]. মাওলানা মওদূদী, রাসায়েল ও মাসায়েল ৫/২৫০ পৃঃ।
[8]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২২২।
[9]. তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন, ত্বোয়াহা ৩৮-৩৯, পৃঃ ৮৫১।
[10]. রাসায়েল ও মাসায়েল ৩/১২০, ৩য় মুদ্রণ ২০০১।
[11]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২২৬।
[12]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৭১৩ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা ও সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায় ৯ অনুচ্ছেদ।
[13]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫৭৩৭ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা ও সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায় ৯ অনুচ্ছেদ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬৬৮।
[14]. কুরতুবী, ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২২২ পৃঃ।
[15]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ক্বাছাছ ৮, ৯।
[16]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২২৩ পৃঃ।
[17]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ক্বাছাছ ৭ আয়াত।
[18]. কুরতুবী, ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ১/২২৫; ঐ, তাফসীর সূরা ত্বোয়াহা ৪০ আয়াত, নাসাঈ, ‘হাদীছুল ফুতূন’।
[19]. বুখারী হা/২৪৮৭ ‘সাক্ষ্য সমূহ’ অধ্যায় ২৮ অনুচ্ছেদ।
[20]. মুস্তাদরাকে হাকেম ২/৩৭৬ পৃঃ হা/৩৩২০, সনদ ছহীহ; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২২৮।
[21]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২৩১।
[22]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৭৬৬, ‘ছালাত’ অধ্যায় ‘সতর’ অনুচ্ছেদ-৮।
[23]. কুরতুবী, তাফসীরে ইবনু কাছীর ‘হাদীছুল ফুতূন’; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২৩৭।
[24]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ত্বোয়াহা ২০/৪০।
[25]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ত্বোয়াহা ৭০; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২৪২।
[26]. তাফসীরে ইবনু কাছীর, ইউনুস ১০/৮৩।
[27]. কুরতুবী, ত্বোয়াহা ২০/৭২-৭৬; তাহরীম ৬৬/১১।
[28].
আবু ইয়া‘লা, ত্বাবারাণী, হাকেম, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৫০৮; আলবানী বলেন,
হাদীছটি আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে মওকূফ ছহীহ, যা মরফূ হুকমীর পর্যায়ভুক্ত।
[29]. তিরমিযী আনাস (রাঃ) হ’তে, মিশকাত হা/৬১৮১ ‘মানাক্বিব’ অধ্যায় ১১ অনুচ্ছেদ; আহমাদ, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে হা/২৬৬৮, সনদ ছহীহ।
[30]. ঐ, তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন (বঙ্গানুবাদ সংক্ষেপায়িত) পৃঃ ৮৬০।
[31]. তাফসীর জাওয়াহের (বৈরুতঃ দারুল ফিকর, তাবি) ৬/৮৪ তাফসীর সূরা ইউনুস ৯২ দ্র:।
[32]. দ্রঃ মওলানা মওদূদী, রাসায়েল ও মাসায়েল (বঙ্গানুবাদ) ২য় সংখ্যা, ১৯৯৬, ৫/৯৮-৯৯ পৃঃ।
[33]. রাসায়েল ও মাসায়েল ৫/৫৫০ পৃঃ।
[34]. হাদীছুল ফুতূন, তাফসীর ইবনু কাছীর, ত্বোয়াহা ৩৯।
[35]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৬৯ ‘ছওম’ অধ্যায়, ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ-৬।
[36]. মুসলিম, মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২০৪১, ২০৬৭।
[37]. বায়হাক্বী ৪/২৮৭; মির‘আত ৭/৪৬।
[38]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৪, ‘ছওম’ অধ্যায় ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ-৬।
[39].
টীকা: মুফতী মুহাম্মাদ শফী স্বীয় তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআনে (বঙ্গানুবাদ
সংক্ষেপায়িত) ৩২০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, মূসা (আঃ) ও বনু ইস্রাঈলগণ সাগরডুবি
থেকে মুক্তি লাভের পর মিসরে আধিপত্য লাভ করেন। কিন্তু ৯৭৭ পৃষ্ঠায় বলেছেন,
কুরআনের একাধিক আয়াত সাক্ষ্য দেয় যে, ফেরাঊন সম্প্রদায়ের ধ্বংসের পর বনী
ইসরাঈল মিসরে প্রত্যাবর্তন করেনি। ... এর পরেও ইতিহাস থেকে একথা প্রমাণিত
হয় না যে, বনী ইসরাঈলগণ কোন সময় দলবদ্ধভাবে জাতিগত পরিচিতি ও মর্যাদা নিয়ে
মিসরে প্রবেশ করেছিল।]
[40]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৭১৩ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায় ৯ অনুচ্ছেদ।
[41].
বুখারী, তিরমিযী, আবুদাঊদ, আহমাদ, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৬২৬২, ৬৪, ৬৫,
৬৭, ৭১, ৭২ ‘মর্যাদা সমূহ’ অধ্যায়, ‘ইয়ামন, শাম ও ওয়ায়েস কুরনীর মর্যাদা’
অনুচ্ছেদ-১৩।
[42]. আহমদ, মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহু, শারহুস সুন্নাহ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯৩৪।
[43]. মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃঃ ১৬৬।
[44]. মাওলানা মওদূদী, রাসায়েল ও মাসায়েল ৫/২৫০।
[45]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ৫৭।
[46]. তিরমিযী, হাদীছ হাসান; মিশকাত হা/৪৫৬৯ ‘চিকিৎসা ও মন্ত্র’ অধ্যায়।
[47]. বিস্তারিত দ্রঃ ডঃ ইকতেদার হোসেন ফারুকী, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে কুরআনে বর্ণিত উদ্ভিদ ই,ফা,বা, ২০০৮, পৃঃ ১৩-২০।
[48]. বুখারী হা/৩৪০৩ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়।
[49]. দ্রঃ বাক্বারাহ ২/৬৩, ৯৩; আ‘রাফ ৭/১৭১।
[50]. মা‘আরেফুল কুরআন, পৃঃ ৩১৭ গৃহীত: তাফসীরে ওছমানী।
[51]. ছহীহ তিরমিযী হা/২৪৭১; আহমাদ, বায়হাক্বী, ইবনু জারীর প্রমুখ।
[52]. মুসলিম, মিশকাত হা/২১১৯ ‘কুরআনের ফযীলত সমূহ’ অধ্যায়।
[53] . মুসলিম, মিশকাত হা/২১২২।
[54]. বুখারী হা/৪৭২৫-২৭ প্রভৃতি; ‘তাফসীর’ অধ্যায় ও অন্যান্য; মুসলিম, হা/৬১৬৫ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায় ৪৬ অনুচ্ছেদ।
[55]. বুখারী হা/৪৭২৭।
[56]. আহমাদ হা/১২৯২৯ ‘সনদ ছহীহ, -আরনাঊত্ব।
[57]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২।