প্রতিবছর প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন গ্যালন তেল গভীর সমুদ্রে পতিত হয়। গভীর সমুদ্রে অবস্থিত তেল উত্তোলন ও বিশোধন স্থাপনাগুলো  থেকে এবং সামুদ্রিক উৎস থেকে বিপুল পরিমান তেল নিঃসৃত হয় যা এই হাজার হাজার গ্যালন তেলের মূল উৎস। এই বিপুল পরিমান তেল সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান তথা পরিবেশ এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য খুবই ক্ষতিকারক।শুধুই তাই নয় দীর্ঘমেয়াদী মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে যথেষ্ট।
মজার বিষয় হলো, সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই বিপুল পরিমান তেল খুব দ্রুতই সমুদ্র থেকে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এই বিপুল পরিমান তেল অপসারন করা একটি সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল কাজ। সম্প্রতি মাইক্রোবায়োলজিস্টরা যেসকল স্থানে বিপুল পরিমান তেল নিঃসৃত হয়েছে সেসব স্থানের পানির স্যাম্পল নিয়ে এসে পরীক্ষা করে এবং সেখানে তেলের পরিবর্তে প্রচুর পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, যাদেরকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন তেল খাদক ব্যাকটেরিয়া(Oil eating bacteria)।
বিজ্ঞানীরা এবং মাইক্রোবায়োলজিস্টরা এরপর থেকেই এই তেল খাদক ব্যাকটেরিয়া নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করেন এবং বিস্ময়কর তথ্য পান। সে গবেষণা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
এই ব্যাকটেরিয়ার দ্রুত বিস্তারের জন্য প্রয়োজন তেল কারণ এই সকল ব্যাকটেরিয়ার আণবিক গঠন এবং বিপাকীয় ও কোষীয় নানা বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন হাইড্রোকার্বন। এসব ব্যাকটেরিয়া এবং অণুজীব তাদের বিপাকীয় কাজে জ্বালানী হিসেবে হাইড্রোকার্বন ব্যবহার করে।
কানাডার তেল, গ্যাস ও শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর মাইক্রোবিয়াল ইকোলজিস্ট কেনেথ লি বলেন,
“তেলের কণা যত ছোট হবে ব্যাকটেরিয়ার জন্য তত সুবিধা হয় ভাঙতে”।আর এই কাজটি করে সাগরের বড় বড় ঢেউ। সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে তেলের বড় বড় কণাগুলো ছোট ছোট কণায় রূপান্তরিত হয় এবং ব্যাকটেরিয়াগুলো দ্রুত তেলের হাইড্রোকার্বনের আণবিক গঠন ভাঙ্গতে শুরু করে এবং একই সাথে নিজেদের বিস্তার এবং বংশবৃদ্ধি শুরু করে। দেখা গেছে যেখানে তেলের ঘনত্ব বেশি সেখানে ব্যাকটেরিয়ার উৎপাদন এবং বিস্তার অত্যাধিক বেশি।


তবে তেল ছাড়াও ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার এবং বিপাকীয় কাজে অন্যান্য উপাদান যেমন, নাইট্রোজেন,অক্সিজেন এর মত উপাদানের প্রয়োজন হয়। আণবিক বিস্তার ও বিপাকীয় কাজের জন্য যতটুকু অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের প্রয়োজন হয় তা ব্যাকটেরিয়া বাতাস থেকে ব্যবস্থা করে ফেলে।ফলে এদের তেমন কোন সমস্যায় পরতে হয় না এবং এরা এদের শারীরিক বৃদ্ধি এবং বংশবিস্তার খুবই ভালভাবে সম্পন্ন করে থাকে।
বিজ্ঞানী অ্যাটলাস এর অভিমত, “এই সকল ব্যাকটেরিয়ার শারীরিক বৃদ্ধি ও কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য আয়রন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস যদি বাহির থেকে দেয়া যায় তবে এদের কার্যকারিতা আরও বাড়বে।”
বাস্তবিক পক্ষে দেখা গেছে, বাহির থেকে এই সকল পুষ্টিগত উপাদান প্রয়োগ করার ফলে ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা স্বাভাবিক কার্যকারিতা থেকে ৩-৫ গুন বৃদ্ধি পায়।
এতে করে বড় কোন বিপর্যয় হলে অর্থাৎ বিশাল পরিমাণে তেল সাগরে ছড়িয়ে পড়লে এভাবে ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার এবং কার্যকারিতা বাড়ানো যাবে এবং দ্রুত এরা তেল অপসারণ শুরু করে দিবে।
এই সকল ব্যাকটেরিয়া খুবই দ্রুত বিলিয়ন বিলিয়ন হাইড্রোকার্বনের চেইন ভেঙ্গে ফেলে যা আমাদের চিন্তাতীত। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো তেলের উপস্থিতিতে অতি দ্রুত শারীরিক বৃদ্ধি সম্পন্ন করে ফলে একই সাথে এরা যেমন অতি দ্রুত তেল অপসারণ করতে পারে তেমনি সংখ্যা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে এরা এদের কাজের অগ্রগতি করে ফেলে। এই রকম একটি ব্যাকটেরিয়া হচ্ছে-Alcanivorax borkumensis.
“যদিও বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে এই সকল ব্যাকটেরিয়া কালচার করে দেখেছেন কিন্তু তা প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় কম কার্যকর বলে মন্তব্য করেছেন সাউদার্ন মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন মাইক্রোবায়োলজিস্ট জে গ্রিম।
মেক্সিকোর গালফে সাম্প্রতিক তেলের ভয়াবহভাবে ছড়িয়া পরার ঘটনা বিজ্ঞানীদের উদ্ভিগ্ন করে এবং একই সাথে তেল খাদক ব্যাকটেরিয়া তাদের নজরে আসে। এছাড়াও আরও কিছু ভয়াবহ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে এই সকল ব্যাকটেরিয়া সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং দ্রুত তেল অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মূলত এভাবেই এই সকল তেল খাদক ব্যাকটেরিয়া বছরের পর বছর সাগর থেকে তেল অপসারণ করে আসছে এবং সাগরের পরিবেশ এবং প্রাণীবৈচিত্র্য রক্ষা করছে এবং করে যাবে।
লেখকঃ সৈয়দ কাউসার আহমেদ,
বায়োটেকনলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং,
মাওলানা ভাসানি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
 
Top